ইতিহাসের ছায়ায় বৃষ্টিভেজা এক বিকেল

আর্মেনীয় গির্জা ঢাকা, চার্চ অব দ্য হোলি রিজারেকশন, পুরান ঢাকা ভ্রমণ, ইতিহাসের ছায়ায়, নাদিয়া রহমান, বৃষ্টিভেজা বিকেল, ঢাকার ঐতিহ্য, আর্মেনীয় চার্চ, পুরান ঢাকার স্থাপত্য, ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহাসিক স্থান ঢাকা, ঢাকা ভ্রমণ, ঢাকা দর্শনীয় স্থান, আর্মেনীয় স্থাপত
আর্মেনীয় গির্জা। ছবি: ইমরান খান

পুরান ঢাকার অলিগলি যেন ঢাকার প্রাণের স্পন্দন। এখানে ইতিহাস মিশে আছে প্রতিটি ইট-পাথরে। এই প্রাচীন শহরের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন এক নিঃশব্দ সাক্ষী—আর্মেনীয় গির্জা—যার আরেক নাম 'চার্চ অব দ্য হোলি রিজারেকশন'। ১৭৮১ সালে নির্মিত এই গির্জা একসময় ঢাকার আর্মেনীয় বসতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। সময় বদলেছে, মানুষও বদলেছে। কিন্তু ইতিহাস যেন এখানে থেমে আছে এক রহস্যময় শান্তিতে।

কয়েক বছর ধরেই আর্মেনীয় গির্জায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কোনো এক সামান্য কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মাঝে আবার বছর দুয়েক দেশেও ছিলাম না। এবার অবশেষে যাওয়া হলো। এর অন্যতম কারণ ছিল সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের মিলওয়াকি শহর থেকে বাংলাদেশ বেড়াতে এসেছেন আমার এক মার্কিন বন্ধু। বাংলা না বুঝলেও পুরোনো স্থাপত্য, জাদুঘর আর শহর ঘুরে দেখার প্রতি বেশ আগ্রহ।

সত্যি বলতে, ঢাকা শহরে মাশরুমের মতোন গজিয়ে ওঠা রেস্তোরাঁ আর ট্রাফিকের শব্দ ছাড়া আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রমণ কিংবা দু'দণ্ড সময় নিয়ে, অগণিত মানুষের হই-হট্টগোল বাদ দিয়ে দেখবার মতোন তেমন কোনো ঐতিহাসিক স্থাপত্য পাইনি। অবশেষে ভেবে দেখলাম আর্মেনীয় গির্জায় যাওয়া যায়। একে তো পুরান ঢাকা, তার ওপর শোরগোল এ জায়গায় নিশ্চয়ই কম।

বৃষ্টি আর মেঘে ঢাকা এক শনিবার ভর দুপুরে আমরা এই গির্জায় গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ঢাকায় তার শেষদিন, পরদিন ফ্লাইট।

গির্জায় পৌঁছানো মাত্রই আমাদের যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরল। চারদিক এতটাই নিস্তব্ধ, মনে হচ্ছিল সময় থেমে আছে। গেট পেরিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়ল শান্ত প্রাঙ্গণ। সারি সারি পুরোনো কবরস্থান, বৃষ্টিতে শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল প্রান্তর। তারই পাশে বসে নীরবে নিজের মতোন করে পানি খাচ্ছি এক বেড়াল। যেন সময়কে আরও থমকে দিলো! সব মিলিয়ে চারপাশে যেন এক ধূসর বিষাদ, বৃষ্টিভেজা দেয়াল, গির্জা, মেঘলা আকাশ, আর গির্জার বারান্দায় পড়ে থাকা ভেজা পাতাগুলো যেন সময়ের স্নিগ্ধ সাক্ষী। বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল কবরস্থানের ফলকগুলো নিয়ে, তাতে লেখা শেষ বিদায়ের নানান স্মৃতি কথা নিয়ে। কিছু ছিল আর্মেনীয় ভাষায়, যার অর্থ বোঝা একজন বাংলাদেশি কিংবা মার্কিন নাগরিকের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

আমরা গির্জার ভেতরে ঢুকলাম। ছোট, সাদামাটা কিন্তু এক ধরনের পবিত্র নীরবতা সেখানে। জানালার কাঁচে পানি জমে আছে, বাইরে ভেজা গাছের পাতার মাঝে হালকা বাতাস দুলছে। গির্জার দেয়ালে টাঙানো আর্মেনীয়দের নাম, যারা একসময় এখানে ব্যবসা করতেন, সমাজ গড়েছিলেন, পরিবার গড়েছিলেন, সব যেন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। ইচ্ছে ছিল ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যাওয়ার, কিন্তু সেটি এখন বন্ধ। গির্জার একপাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। শান্ত, নির্জন। সেই নির্জনতায় কথা হচ্ছিল জীবনের নানা বিষয় নিয়ে, ভবিষ্যৎ, স্মৃতি, বিদায়!

আর্মেনীয় গির্জা ঢাকা, চার্চ অব দ্য হোলি রিজারেকশন, পুরান ঢাকা ভ্রমণ, ইতিহাসের ছায়ায়, নাদিয়া রহমান, বৃষ্টিভেজা বিকেল, ঢাকার ঐতিহ্য, আর্মেনীয় চার্চ, পুরান ঢাকার স্থাপত্য, ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহাসিক স্থান ঢাকা, ঢাকা ভ্রমণ, ঢাকা দর্শনীয় স্থান, আর্মেনীয় স্থাপত
ছবি: ইমরান খান

মানুষ হিসেবে আমি বেশ স্মৃতিকাতর, কিংবা বলা যায় বিভিন্ন দর্শনশাস্ত্র আর জাদুবাস্তবতার বই পড়ে ইট-কাঠের এই ঘন বসতিতে নিজের এক জগত তৈরি করে নেওয়া আমার মজ্জাগত। নানান কারণেই মনে হচ্ছিল, বন্ধুটির সঙ্গে এই বুঝি শেষ দেখা। হয়তো তাই! এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসাও তো চাট্টেখানি কথা নয়। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি এবং নতুন এক দেশ। নিজে যখন দু'বছর ছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকিতে, মনে হতো সবই আছে এই বিশাল প্রান্তরে, শহরে, তারপরেও কোথায় যেন কী নেই! মহীনের ঘোড়াগুলোর মতোন মনে হতো, 'কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও!'

সব শেষে ফেরার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, আমরা নিজেরাও সময়ের একটা পাতায় স্মৃতি রেখে গেলাম। আর্মেনীয় গির্জা শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি এক নিঃশব্দ ইতিহাস, হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায়ের পাতা। আর আমাদের সেই বিকেলটা ছিল যেন সেই পাতার এক বিশেষ মুহূর্ত, আধো বৃষ্টি, আধো রোদ্দুর, দু'প্রান্তের মানুষের বন্ধুত্ব, আর অবশেষে স্মৃতিতে থাকার মতোন একটি বিকেল।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

4h ago