মানসিক সমস্যা ইটিং ডিজঅর্ডারের কারণ ও লক্ষণ, সমাধানে করণীয়

ইটিংডিজঅর্ডার
ছবি: সংগৃহীত

ইটিং ডিজঅর্ডার হচ্ছে মানুষের খাদ্যাভাসের আচরণজনিত একটি মানসিক সমস্যা। ইটিং ডিজঅর্ডার বা খাওয়ার ব্যাধি সম্পর্কে জেনে নিন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে।

ইটিং ডিজঅর্ডার কী ও কেন হয়

ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, মানুষের খাদ্যাভাসের আচরণ, খাদ্য গ্রহণ করার আচরণ, খাবার নিয়ে চিন্তা এবং তার আবেগের যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে তাকেই ইটিং ডিজঅর্ডার বলা হয়।

কখনো কখনো ইটিং ডিজঅর্ডার এত বেশি জটিল আকার ধারণ করে যা মানুষকে গুরুতর অসুস্থতার দিকে নিয়ে যায়। এমনকি মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইটিং ডিজঅর্ডার মূলত পাশ্চাত্যে বেশি দেখা যেত। বাংলাদেশ, ভারতসহ এই অঞ্চলে এই রোগটি কম ছিল। তবে ইদানিং দেশে ইটিং ডিজঅর্ডারের প্রার্দুভাব বাড়ছে।

ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ইটিং ডিজঅর্ডার কেন হয় তার একক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাধারণত জেনেটিকলি বা বংশে যদি কারো ইটিং ডিজঅর্ডার থাকে তখন হতে পারে। কারো যদি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার থাকে তাহলে ইটিং ডিজঅর্ডার থাকতে পারে। মনোসামাজিক ক্ষেত্রে অনেক সময় কেউ যখন তার শারীরিক ওজন নিয়ে, চেহারা নিয়ে চিন্তা করেন, শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সচেতন থাকেন তখন তার ভেতর ইটিং ডিজঅর্ডার আসতে পারে। বুলিংয়ের কারণে হতে পারে।

বিশেষত ইটিং ডিজঅর্ডার নারী, টিনএজার, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ। এ ছাড়া যাদের অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার বা শুচিবাই আছে, উদ্বেগ, হতাশা, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার আছে, পরিবারে কারো মানসিক রোগ আছে তাদের ইটিং ডিজঅর্ডার হতে পারে।

ইটিং ডিজঅর্ডারের ধরন

অনেক ধরনের ইটিং ডিজঅর্ডার আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়া নার্ভোসা।

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত ব্যক্তি খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। ওজন বেড়ে যাবে সেই ভয়ে থাকেন। যার কারণে ঠিকমত খাবার খার না, খাবার খাওয়া বন্ধ থাকেন, খেলেও খুব অল্প পরিমাণে খান, কিছু বিশেষ বিশেষ খাবার তিনি গ্রহণ করেন। শরীরের ওজন কমানোর চেষ্টা করেন, নিয়মিত ওজন মাপার চেষ্টা করেন এবং ওজন কমে যায়।

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্তরা কখনো কখনো খাবার খাওয়া এমনভাবে সীমাবদ্ধ করে দেন যে এর ফলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তাদের ওজন কমে যায়, বডি ইমেজ পাল্টে যায়, ফ্যাটিগ লাগে, পুষ্টির অভাব থাকায় চুলের গড়ন নষ্ট হয়ে যায়, হাতের নখে সমস্যা হয়, চামড়া পাতলা হয়ে যায়, ব্লাড প্রেশার কম থাকে।

বুলিমিয়া নার্ভোসা

বুলিমিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত ব্যক্তি খাবার খেয়ে ফেলেন এবং বেশি পরিমাণেই খান। খাবার খাওয়ার পর আবার সচেতন হয়ে যান। খাওয়ার পর তাদের মনে হয় খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। শরীরের ওজন বেড়ে যাবে এমন নানাবিধ চিন্তায় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বমি করে ফেলেন। অথবা ল্যাক্সিটিভ খেয়ে খাবার বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত ব্যায়াম করেন, ফাস্টিং করেন, দৌড়ান বেশি।

বুলিমিয়া নার্ভোসা থাকার কারণে গলায় আঙুল দিয়ে জোর করে বমি করার ফলে গলা ফুলে যায়, গলার ভেতর ব্যথা হয়, লালা গ্রন্থিতে সমস্যা হয়, বার বার বমির কারণে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যায়, ডিহাইড্রেশন হতে পারে।

বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডার

বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডার থাকা ব্যক্তিরা একসঙ্গে অনেক বেশি পরিমাণ খাবার খেয়ে ফেলেন। তবে খাওয়ার পর নিজে থেকে বমি করেন না। তিনি যখন খাওয়া শুরু করেন তখন অত্যাধিক পরিমাণে খান, এতে করে ওজন বেড়ে যায়।

এভয়েডেন্ট রেস্ট্রিকটিভ ফুড ইনটেক ডিসঅর্ডার

কিছু কিছু খাবারের ক্ষেত্রে ওসিডি বা শুচিবাইয়ের মত বৈশিষ্ট্য থাকে। তারা সেসব খাবার খেতে পারেন না, পছন্দ করেন না, দেখতেই পারেন না। বিভিন্ন ধরনের খাবারের ক্ষেত্রে ড্রামাটিক রেস্ট্রিকশন হয় এবং নাটকীয়ভাবে ওজন হ্রাস পায়।

ইটিং ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা

ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রথমত ইটিং ডিজঅর্ডারের মূল চিকিৎসা হচ্ছে শারীরিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ঠিক রাখার চেষ্টা করা। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খাদ্য, পানি ও লবণের ঘাটতি যেন না হয় এবং খাবার ও পানির অভাবে লিভার ও রেনাল ফাংশন নষ্ট না হয় সেটি ঠিক রাখা। ইটিং ডিজঅর্ডারের কারণে যাদের শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে সেই ক্ষতি কমানো এবং স্বাস্থ্য ভালো রাখাই প্রথম লক্ষ্য।

দ্বিতীয়ত রোগীর আচরণ পরিবর্তন করার জন্য কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি অর্থাৎ আচরণগত কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। কাউন্সিলিং সাইকোথেরাপির মধ্য দিয়ে ইটিং ডিজঅর্ডারের আচরণ থেকে বিরত রাখা।

তৃতীয়ত হচ্ছে ওষুধ। যদিও ইটিং ডিজঅর্ডারে ওষুধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীকে এন্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ দেওয়া হয়।

একক চিকিৎসকের পক্ষে ইটিং ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা করা জটিল। এই রোগ নির্ণয়ের জন্য সাইকিয়াট্রিসস্টের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং পুষ্টিবিদ এই তিন ধরনের চিকিৎসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে রোগীকে কাউন্সিলিং দেওয়ার জন্য একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট প্রয়োজন হয়। সমন্বিতভাবে ইটিং ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা করতে হবে। পাশাপাশি পরিবারেরও দায়িত্ব রয়েছে। যার ইটিং ডিজঅর্ডার হচ্ছে তাকে বুলিং না করা, তার প্রতি কোনো ধরনের বিরুপ মন্তব্য না করা, তাকে সহায়তা করা, সাহস যোগানো এবং চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা পরিবারে কাজ। এটি একটি ক্রনিক ডিজঅর্ডার, এর দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।

টিনএজার, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে রাতে জেগে থাকা, দিনে ঘুমানোর বদ অভ্যাস, তাদের আচরণগত যে পরিবর্তন হচ্ছে সেগুলো ঠিক রেখে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইটিং ডিজঅর্ডার অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

Comments

The Daily Star  | English
FY2026 Budget,

How the FY2026 budget can make a difference amid challenges

The FY2026 budget must be more than a mere fiscal statement.

15h ago