হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া রোগ ‘বেলস পালসি’র ঝুঁকিতে কারা, করণীয় কী

বেলস পালসি, মুখ বেঁকে যাওয়া, মুখ বেঁকে গেলে কী করবেন, বেলস পালসি লক্ষণ, বেলস পালসি চিকিৎসা, বেলস পালসি প্রতিকার, ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস, মুখের পক্ষাঘাত, মুখ বেঁকে যাওয়ার কারণ, মুখ বেঁকে যাওয়ার চিকিৎসা, হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া, বেলস পালসি ফিজিওথেরাপি, মুখ
ছবি: সংগৃহীত

হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া যেকোনো মানুষের কাছেই আতঙ্কের। বেলস পালসি রোগে এই সমস্যা হয়।

রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) চট্টগ্রাম শাখার ফিজিওথেরাপি বিভাগের ইনচার্জ ও সিনিয়র ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক মো. আইনুর নিশাদ রাজিব।

বেলস পালসি কী

ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ ডা. আইনুর নিশাদ বলেন, বেলস পালসি হলো মুখের একপাশের মাংসপেশীর আকস্মিক দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত। সাধারণত মুখের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণকারী ৭ নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভে (ফেসিয়াল নার্ভ) প্রদাহ, ফোলা বা চাপের ফলে এটি হয়ে থাকে। রোগটির নামকরণ করা হয়েছে স্কটিশ সার্জন চার্লস বেলের নামানুসারে। বাংলাদেশে এই রোগের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও নিউরোসায়েন্সের কিছু জার্নাল ও বইপত্রে দেখা গেছে, প্রতি লাখে ২০ জন মানুষ বেলস পালসিতে আক্রান্ত। এটি পুরুষ এবং নারী উভয়েরই হতে পারে। তবে কিছু গবেষণায় নারীদের মধ্যে এর প্রবণতা সামান্য বেশি দেখা গিয়েছে।

কেন হয়

বেলস পালসি হওয়ার সঠিক কারণ অজানা হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ভাইরাস সংক্রমণ, যেমন: হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস বা স্নায়ুর প্রদাহের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সিজন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল সংক্রমণ (ঠান্ডা লাগা, ফ্লু, হার্পিস) হলে এই রোগ হতে পারে। এ ছাড়া তাপমাত্রার (ঠান্ডা বা গরমের) হঠাৎ পরিবর্তন শীতের শুরুতে কিংবা শীতের শেষে গরমের শুরুতে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির মোক্ষম সময়। বংশবৃদ্ধি বেশি হলে তখন ভাইরাসের আক্রমণও বেশি হবে। এই সময়গুলোতে বেলস পালসি বেশি হয়। আবার অন্য সময়গুলোতেও হতে পারে।

ঝুঁকিতে কারা

যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, ডায়াবেটিস আছে, গর্ভাবস্থা (বিশেষ করে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে), মানসিক চাপ ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের বেলস পালসি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

লক্ষণ

ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ আইনুর নিশাদ বলেন, সাধারণত এই রোগের লক্ষণগুলো আকস্মিকভাবে শুরু হয়। ঘুম থেকে ওঠার পরে কিংবা ধীরে ধীরে সাধারণত কয়েক ঘণ্টা বা দিনের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে।

১. অনেকেই ঘুম থেকে ওঠার পরে আয়নার সামনে গিয়ে লক্ষ করেন তার মুখ একপাশে বাঁকা হয়ে গিয়েছে।

২. যার ফলে রোগী হাসতে বা মুখভঙ্গি দিতে পারে না, মুখ একদিকে ঝুলে বা বেঁকে যায়।

৩. খাবার চিবিয়ে খেতে পারবে না, খাবার আটকে যাবে।

৪. কুলি করতে গেলে মুখের একপাশ দিয়ে পানি বের হয়ে যাবে।

৫. আক্রান্ত চোখে জল আসা বা শুষ্কতা হয়, চোখ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে না।

৬. অনেক সময় স্বাদ অনুভবে পরিবর্তন হয়।

৭. এ ছাড়াও শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিসহ আক্রান্ত কানের কাছাকাছি বা পেছনে হালকা ব্যথা হতে পারে।

তবে মনে রাখতে হবে অনেক সময় বেলস পালসির লক্ষণ স্ট্রোকের মতো মনে হতে পারে। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে মুখ ছাড়াও শরীরের অন্যান্য অংশ প্রভাবিত হয়, যেমন: মুখ বেঁকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক হাত ও পায়ে দুর্বলতা।

চিকিৎসা

ওষুধ ও ফিজিওথেরাপি হচ্ছে বেলস পালসি রোগের মূল চিকিৎসা। এজন্য একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান বা নিউরোলজিস্ট এবং সেই সঙ্গে অবশ্যই একজন ফিজিওথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। সাধারণত স্নায়ুর প্রদাহ কমানোর জন্য স্বল্পমেয়াদি কর্টিকোস্টেরয়েডস (Corticosteroids) এবং ক্ষেত্রবিশেষে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে।

ওষুধের পাশাপাশি ইলেক্ট্রোথেরাপি এবং ম্যানুয়াল থেরাপি এই দুই ক্যাটাগরিতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা করা হয়।

নার্ভে ফোলা বা প্রদাহ কমাতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আলট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং সেই সঙ্গে সফট টিস্যু মোবিলাইজেশন, প্রোপায়রো সেপ্টিক নিউরোমাস্কুলার ফেসিলেশন অ্যাপ্রোচ (PNF Approach), মোটর পয়েন্ট স্টিমুলেশন, অ্যাকটিভ অ্যাসিসটেড ও অ্যাক্টিভ এক্সারসাইজ, স্ট্রেন্দেনিং এক্সারসাইজ করা হয়।

এর পাশাপাশি চোখ বন্ধ না হলে চোখকে শুষ্ক হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য কৃত্রিম অশ্রু (Artificial Tears) ব্যবহার এবং রাতে আই-প্যাচ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে।

জটিলতা

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী সঠিক ওষুধ ও নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে প্রায় আট সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। কারও ক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগে। তরুণরা দ্রুত সুস্থ হয়। বয়স্কদের সুস্থ হতে সময় লাগে। ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা থাকে, যেমন: মুখ কিছুটা বাঁকা থেকে যেতে পারে। তবে দীর্ঘসময় ধরে ফিজিওথেরাপি দিতে পারলে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। অনেক সময় একটি অদ্ভুত জটিলতা দেখা যায়, খাওয়ার সময় চোখ দিয়ে জল পড়ে, একে ক্রকোডাইল টিয়ার্স সিনড্রোম বলা হয়। সাধারণত এটি ক্ষতিকর নয়, তবে সমস্যা বেশি হলে বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

করণীয় ও সতর্কতা

বেলস পালসি প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে ডায়াবেটিস ও প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। যাদের একটুতেই সর্দি-কাশি হয়, তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একটু হলেও কম থাকে।

বেলস পালসি চিকিৎসা চলাকালীন রোগীকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন:

১. ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।

২. ঠান্ডা জাতীয় খাবার, যেমন: আইসক্রিম ও ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার পরিহার করতে হবে।

৩. বাইরে বা রোদে গেলে সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে, যেন আক্রান্ত চোখে ময়লা না ঢুকতে পারে।

৪. রাতে ঘুমানোর সময় আক্রান্ত চোখের ওপর নরম কাপড় বা রুমাল দিয়ে রাখতে হবে, যাতে কোনোকিছু চোখের মধ্যে না পড়ে।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda Zia laid to eternal rest

Buried with state honours beside her husband Ziaur Rahman

9h ago