চল্লিশে শারীরিক পরিবর্তন—পেরিমেনোপজ কি দায়ী?

চল্লিশে শারীরিক পরিবর্তন—পেরিমেনোপজ কি দায়ী?
ছবি: এলএস

বয়স যখন চল্লিশের কোঠায় তখন নারীদের শরীরে নানা শারীরিক জটিলতার লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রত্যেকেরই শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে চল্লিশের কোঠায় বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে পেরিমেনোপজ দেখা দেয়। তাই এই সময়ে শরীরের পরিবর্তন এবং সেক্ষেত্রে কী কী করণীয় তা সম্পর্কে আগে থেকে জেনে রাখা জরুরি।

মেনোপজের আগে শরীর ধীরে ধীরে মেনোপজের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে, যা পেরিমেনোপজ নামে পরিচিত। এই সময়ে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে শুরু করে। শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো ওজন বৃদ্ধি, ত্বকের মলিনতা এবং ক্লান্তি। চিকিৎসকদের মতে, এই ওজন বৃদ্ধি কেবল স্কেলের সংখ্যা বাড়ার বিষয় নয়, বরং স্থূলতা বেড়ে শরীরের আকৃতিতেও পরিবর্তন।

ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ে, কুঁচকে যায়, বলিরেখা তৈরি হয় এবং কোলাজেনের ঘাটতির কারণে নমনীয়তা হারায়। মেডিটেক জেনারেল হাসপাতালের অবস গাইনি বিভাগের আরএমও ডা. কাজী আজমিরী হক বলেন, 'এই সময়ে অনেক নারীর মুখের কোমলতা কমে যায় এবং শরীরের ফিটনেসও আর আগের মতো থাকে না। এ ছাড়া অনেকের মুখে অবাঞ্ছিত লোমও দেখা দিতে পারে।'

যদিও এই বয়সে অনেক নারী চুল পড়ার সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তবে এটি সবার ক্ষেত্রেই ঘটবে এমনটা নয়।

ইস্ট্রোজেন হরমোনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জয়েন্টকে নমনীয় রাখা। চল্লিশের পর এই হরমোনের মাত্রা কমে যেতে থাকে, যার ফলে জয়েন্টের নমনীয়তা হ্রাস পায়। এর ফলে হাত-পা নাড়ানো বা চলাফেরা করা কষ্টকর হয়ে যায় এবং মেরুদণ্ড ও কোমরে ব্যথা দেখা দেয়, বিশেষ করে যাদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) বেশি, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও তীব্র হয়।

এ সময়ে নারীদের পেশি শক্তি প্রায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যার ফলে ফ্র্যাকচার এবং অস্টিওপরোসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পেরিমেনোপজের অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন, চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া, সন্তান জন্ম দেওয়া নারীদের পেলভিক পেশির দুর্বলতা, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি এবং স্মৃতিশক্তি লোপ যাওয়া।

এগুলো কেবল পেরিমেনোপজের প্রাথমিক কিছু লক্ষণ মাত্র। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে, আর ইস্ট্রোজেন এই পরিবর্তন ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে একটি সুরক্ষা কবচের মতো কাজ করে। শরীরে এই হরমোনের মাত্রা কমে গেলে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

শেষ ঋতুস্রাবের আগে শরীরে হরমোনের মাত্রা বেশ ওঠানামা করে। যার ফলে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, হঠাৎ প্রচণ্ড গরম লাগা (হট ফ্ল্যাশ), যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যাওয়া এবং তীব্র মুড সুইংয়ের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ডা. আজমিরী হকের ভাষ্য, 'মেনোপজ নিয়ে বহু নারীর মনে অযথা ভয় ও অস্বস্তি কাজ করে। তাদের ধারণা, এই পর্যায়ে পৌঁছালে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাবে বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় প্রভাব পড়বে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি তেমন নয়। মেনোপজের পরও নারীদের যৌন আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক থাকে এবং শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এতে কোনো বিরূপ প্রভাব দেখা যায় না।'

এই সময়ে যোনিপথে শুষ্কতা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে লুব্রিকেন্ট ব্যবহারে অনেকটাই স্বস্তি পাওয়া সম্ভব। এসব বিষয় অনেক নারীর মনে উদ্বেগ বা ভীতি সৃষ্টি করতে পারে। তবে সব নারীর ক্ষেত্রেই এগুলো ঘটে এমন নয়। একসঙ্গে সব সমস্যা হওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ডা. আজমিরী হক বলেন, 'চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের মধ্যে কেউ হয়তো কিশোর-কিশোরী সন্তানদের দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আবার কেউ বা বয়স্ক বাবা-মায়ের যত্নে ব্যস্ত থাকেন। এসব কারণে তারা মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন, যা শরীরে নানা ধরনের ব্যথা-বেদনার আকার ধারণ করতে পারে। অনেক চিকিৎসক ভুলবশত এসব সমস্যা মেনোপজের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেন, যার ফলে নারীদের মনে অহেতুক ভ্রান্ত ভীতি কাজ করে।'

চল্লিশের কোঠায় পৌঁছে নারীরা পেরিমেনোপজের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার জন্য আগেভাগেই কিছু প্রস্তুতি নিতে পারেন। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রা ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

একজন ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। তিনি ফাইটোএস্ট্রোজেন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন: তিসি, সয়া ও ডালজাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন, যা রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। সঙ্গে নিকোটিন, ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় তুলনামূলকভাবে কম গ্রহণের পরামর্শও দিতে পারেন।

নারীরা নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারেন এবং স্ট্রেস কমানোর জন্য ইয়োগা বা মেডিটেশন করতে পারেন। রাতে নিয়মিত আট ঘণ্টার ঘুম নিশ্চিত করা এবং ঘুমোতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকে স্ক্রিন টাইম বন্ধ রাখার অভ্যাস অবসাদ কমানো ও স্মৃতিশক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।

আপনি যদি আগে থেকেই জানেন আপনার শরীরে কী পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, তাহলে ধরে নিন যে মানসিক যুদ্ধের অর্ধেকটাই আপনি জিতেছেন। পেরিমেনোপজের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় আপনি বুঝতে পারবেন কী ঘটবে এবং তা মোকাবিলায় কী করা উচিত। ফলে, এই পরিবর্তনকে নিয়ে অযথা ভয় বা দুশ্চিন্তা থাকবে না। এই সময়টিকে হাসিমুখে এবং নিশ্চিন্তে গ্রহণ করার জন্য আপনি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

অনুবাদ করেছেন শবনম জাবীন চৌধুরী

Comments