হিস্টিরিয়া কী, লক্ষণ ও করণীয়

হিস্টিরিয়া কী, লক্ষণ ও করণীয়
ছবি: সংগৃহীত

হিস্টিরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ অনেকের কাছে ভান, অভিনয় কিংবা পাগলামি। এর চিকিৎসা নিয়েও রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা। মূলত হিস্টিরিয়া একটি মানসিক সমস্যা, যেখানে মানসিক কষ্টের কারণে শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। হিস্টিরিয়া রোগটি বর্তমানে কনভার্সন ডিসঅর্ডার নামেই স্বীকৃত।

এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

কনভার্সন ডিসঅর্ডার কী, কেন হয়

অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অতীতে হিস্টিরিয়া বলতে সাধারণভাবে যে সমস্যাকে বোঝাত, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সেটিকে বলা হয় কনভার্সন ডিসঅর্ডার।

কনভার্সন ডিসঅর্ডার হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, মনের ভেতর জমে থাকা কোনো দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ব্যাহত হয় এবং কনভার্সন ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। এখানে শারীরিক, স্নায়বিক ও মানসিক কিছু লক্ষণ থাকতে পারে। মানসিক লক্ষণ যখন প্রকাশ পায়, তখন এটাকে বলা হয় ডিসোসিয়েটিভ কনভার্সন ডিসঅর্ডার।

যাদের ভেতর মানসিক চাপ, নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করার সক্ষমতা কম, ঘাত সহনশীলতা কম, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা কম, ছোটবেলা থেকে অতিরিক্ত সুরক্ষায় বড় করা হয়েছে, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে জানার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যাদের সামাজিক দক্ষতা কম তাদের ভেতর কনভার্সন ডিসঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। নারীদের ভেতর কনভার্সন ডিসঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা পুরুষদের তুলনায় বেশি। এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিকালের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে হিস্টিরিয়ার আশঙ্কা বেশি।

লক্ষণ

১. শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া, হাইপারভেন্টিলেশন এবং দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি

২. অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো আচরণ

৩. খিঁচুনির মতো আচরণ

৪. হঠাৎ করে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কথা বলতে না পারা

৫. চোখে কম দেখা বা দৃষ্টিহীনতা

৬. হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া, বোধশক্তিহীন হয়ে যাওয়া

৭. পেটের ভেতর অস্বস্তিবোধ হওয়া, বুক ধড়ফড়

৮. পরিচিত জায়গা চিনতে না পারা, আপনজনদের চিনতে না পারা

৯. শিশুসুলভ, নাটকীয় আচরণ করা

এরকম নানাবিধ লক্ষণ কনভার্সন ডিসঅর্ডারে হতে পারে। অনেক সময় মানুষ এটিকে ভান বা অভিনয় মনে করে। কিন্তু আসলে তা নয়, রোগী সত্যিই এ ধরনের লক্ষণ অনুভব করেন। রোগী যখন এ ধরনের আচরণ করেন, তখন আশেপাশের মানুষ তার প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়। ফলে অন্যান্যদের থেকে পাওয়া অধিক মনোযোগ রোগীকে এ ধরনের আচরণ করতে আরও বেশি উৎসাহিত করে।

চিকিৎসা ও করণীয়

অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, হিস্টিরিয়া বা কনভার্সন ডিসঅর্ডার হলে রোগী ও তার স্বজনদের আশ্বস্ত করতে হবে এটি একটি মানসিক রোগ, এটি সত্যিকারের শারীরিক রোগ নয়। এক্ষেত্রে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি শনাক্ত করবেন। রোগীকে কাউন্সেলিং করতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ দিতে হবে। এ ছাড়া রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ও লক্ষণের দিকে মনোযোগ কম দিতে হবে। যত বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে, দেখা যাবে রোগীর ভেতর হিস্টিরিয়ার লক্ষণগুলো তত বাড়ছে।

একাধিকবার লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ রোগীর খিঁচুনি হলে সেটি প্রকৃত খিঁচুনি নাকি হিস্টিরিয়ার খিঁচুনি সেটি জানা জরুরি।

কনভার্সন ডিসঅর্ডার প্রতিরোধে কোনো ব্যক্তির ভেতর চাপ ও ঘাত সহনশীলতা বাড়াতে হবে। কারণ একই ঘটনায় সবার কিন্তু হিস্টিরিয়া হয় না। শৈশব থেকেই চাপ গ্রহণ ও মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাড়াতে পারলে হিস্টিরিয়া হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। সর্বোপরি লক্ষণের দিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। যত গুরুত্ব দেওয়া হবে, হিস্টিরিয়ার সমস্যা তত জটিল হবে।

ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, ধমক দেওয়া, ভয় দেখানোসহ সমাজে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে হিস্টিরিয়া আক্রান্ত রোগীর জন্য। এসব ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সচেতনতা, সবার সহযোগিতা ও সঠিক চিকিৎসায় রোগ ভালো হওয়া সম্ভব।

Comments