মানুষ কেন ঘুমের মধ্যে হাঁটে, কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত

মানুষ কেন ঘুমের মধ্যে হাঁটে, কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত
ছবি: সংগৃহীত

স্লিপওয়াকিং ডিজঅর্ডারকে বলে সমনাম্বুলিজম। ঘুমের মধ্যে হাঁটা এক ধরনের অস্বাভাবিক ঘুমের আচরণ। একজন ব্যক্তিকে ঘুম ও জাগ্রত হওয়ার মাঝামাঝি অবস্থায় ফেলে দিতে পারে এই সমস্যা।

এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, কথাসাহিত্যিক এবং মনোশিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল।

স্লিপওয়াকিং কী

স্লিপওয়াকিং বা সমনাম্বুলিজম হলো ঘুমের ভেতর স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাঁটা-চলা বা বিভিন্ন কাজ করা। বিষয়টা বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে দুই ধরনের ঘুমের কথা।

প্রথমত 'র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ' (আরইএম-স্লিপ), এ ধরনের ঘুমের সময় চোখ দ্রুত নড়াচড়া করে। এই পর্বে আমরা স্বপ্ন দেখে থাকি, মস্তিষ্ক বেশি সক্রিয় থাকে।

দ্বিতীয়ত নন-রে‍ম (এন-আরইএম) ঘুম হলো ঘুমের শান্ত ও গভীর পর্যায়। শরীর ও মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়, পেশি শিথিল হয়, হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর হয়ে আসে এ সময়। শরীরকে পুনর্গঠন, হাড় ও পেশি তৈরি এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং মোট ঘুমের প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ সময়জুড়ে থাকে এ ধরনের ঘুম।

প্রায় ৯০ মিনিটের প্রতিটি ঘুমচক্রে এন-আরইএম এবং আরইএম উভয় পর্যায়ই অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা রাতে ৪-৫ বার ঘটে।

অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ঘুমের মধ্যে হাঁটার সমস্যা বিষয়ে বুঝতে হলে নন-রেম ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় নিয়েও কিছুটা জানতে হবে। নন-রেম ঘুমকে তিনটি ধাপে ভাগ করা যায় স্তর পেরিয়ে হালকা ঘুম থেকে গভীর ঘুমে রূপান্তরিত হয়। নিচে পর্যায়গুলো তুলে ধরা হলো:

পর্যায় ১ (এন১): এটি হালকা ঘুমের শুরু, যেখানে ঘুমিয়ে পড়া শুরু হয়, মস্তিষ্ক সুস্থির হতে থাকে।

পর্যায় ২ (এন২): এটি হালকা ঘুমের দ্বিতীয় ধাপ। হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস ধীরে হয়, পেশি শিথিল হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে, কিন্তু মস্তিষ্কের তরঙ্গে কিছু স্পন্দন দেখা যায় এই পর্যায়ে।

পর্যায় ৩ (এন৩): এটি গভীর ঘুম, যা শারীরিক পুনরুদ্ধার ও বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।

স্লিপওয়াকিং ঘটে নন-রেম ঘুমের গভীর স্তরে (স্টেজ ৩/৪)—অর্থাৎ যখন মস্তিষ্ক আংশিকভাবে ঘুমন্ত ও আংশিকভাবে জাগ্রত অবস্থায় থাকে। স্টেজ ফোরে চোখের নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। ঘুম ভাঙার পর আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত পরে কিছুই মনে রাখতে পারে না।

কেন হয়

স্লিপওয়াকিং কোনো একক কারণে ঘটে না। সাধারণত নিচের সম্ভাব্য কারণগুলো ভূমিকা রাখে।

শারীরিক কারণ

১. জৈবিক ও শারীরবৃত্তীয় কারণ

২. জেনেটিক (পরিবারে থাকলে ঝুঁকি বাড়ে)

৩. ঘুমের ঘাটতি

৪. অতিরিক্ত ক্লান্তি

৫. জ্বর (বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে)

৬. ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট বা অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া

৭. জিইআরডি (অ্যাসিড রিফ্লাক্স)

৮. রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম

মানসিক কারণ

১. তীব্র চাপ, দুশ্চিন্তা, মানসিক ক্লান্তি

২. পিটিএসডি বা নাইট টেরোরের ইতিহাস

ওষুধ বা রাসায়নিক কারণ

১. সিডেটিভ, হিপনোটিক অথবা কিছু অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট

২. অ্যালকোহল বা ড্রাগ ব্যবহারের পরে

পরিবেশগত কারণ

১. অনিরাপদ ঘুমের পরিবেশ

২. অতিরিক্ত শব্দ, আলো

লক্ষণ

১. ঘুমের ভেতর দুর্বল বা কঠিন পদক্ষেপে হাঁটা

২. চোখ খোলা থাকলেও 'ফাঁকা' দৃষ্টি বা চোখের চাহনিতে শূন্যতা ফুটে ওঠা

৩. শরীরের নড়াচড়া স্বয়ংক্রিয় থাকে

৪. মুখে কথা হলেও অর্থহীন

৫. দরজা-জানালা খোলা, রান্নাঘরে যাওয়া, পোশাক বদলানোর মতো কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে

৬. ঘুম থেকে জেগে উঠলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে

৭. সকালে উঠে কিছুই মনে না থাকা

৮. শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এই প্রবণতা, বয়স বাড়ার সঙ্গে কমে

স্লিপওয়াকিং হলে করণীয়

  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ কৌশল হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  • দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে।
  • সিঁড়ির সামনে বেবি-গার্ড বসাতে হবে।
  • ধারালো জিনিস দূরে রাখতে হবে।
  • ঘরের ফ্লোর পরিষ্কার রাখা জরুরি।
  • আক্রান্তকে হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে জোরে ডাকা উচিত নয়; ধীরে ধীরে গাইড করে বিছানায় ফিরিয়ে নিতে হবে। হঠাৎ চমকে উঠলে ভয় বা আঘাত লাগতে পারে।
  • ঘুমের শৃঙ্খলা উন্নত করার নজর দিতে হবে। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো-জাগা নিশ্চিত করা জরুরি। পর্যাপ্ত ঘুম (বয়স্কদের ৭-৯ ঘণ্টা), ঘুমানোর ২-৩ ঘণ্টা আগে ফোন বা স্ক্রিন-টাইম কমানো।
  • রাতে ভারী খাবার বা কফি এড়িয়ে চলতে হবে
  • স্ট্রেস কমাতে শিখে নিতে হবে নানা কৌশল, যেমন: মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স রাখা জীবনচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে হবে।

কখন ডাক্তার দেখানো উচিত

নিচের যেকোনোটি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন:

সপ্তাহে বারবার স্লিপওয়াকিং হলে কিংবা ঘর বা আশেপাশে আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি থাকলে, বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মতো আচরণ ঘটলে, চিৎকার, হিংসাত্মক নড়াচড়া (স্লিপ টেরোরের সম্ভাবনা), শ্বাসকষ্ট, নাক ডাকা, ঘুমে দম বন্ধ হওয়া (স্লিপ অ্যাপনিয়ার ইঙ্গিত)—এসব উপসর্গ তৈরি হলে জরুরি নজর দিতে হবে। এ ছাড়া প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে হঠাৎ স্লিপওয়াকিং শুরু হওয়া, হতাশা, উদ্বেগ বা পিটিএসডির সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

চিকিৎসা

অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, কারণ-নির্ভর চিকিৎসা কৌশলই গুরুত্বপূর্ণ। স্লিপওয়াকিং কেন হচ্ছে, তা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে রোগীকে।

স্লিপ হাইজিন ও বিহেভিয়ার থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (সিবিটি), রিলাক্সেশন ট্রেনিং, শিডিউল ওয়াকিং (ঘুমানোর এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর হালকা জাগিয়ে দেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে খুব কার্যকর)।

যদি স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকে তাহলে সিপিএপি থেরাপি, গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) থাকলে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর যদি ওষুধজনিত সমস্যা হয় তাহলে বিকল্প প্রেসক্রিপশন।

ঘুমের ব্যাঘাত বা নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বেশি হলে চিকিৎসক সেই অনুযায়ী ওষুধ দেবেন।

Comments