মানুষকে প্রশ্নের মুখোমুখি করিয়ে ফসের নোবেল জয়

ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ইয়ন ওলিভ ফসে। অন্যান্য লেখার বাইরে তিনি নাটক লেখার জন্য বেশি পরিচিত। ৬৪ বছর বয়সী এই লেখক সম্পর্কে সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলছেন, 'তিনি যাই লিখুন না কেন, সবগুলোতেই উপস্থিত থাকে এমন কিছু, যা মানুষকে প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড় করায়'।

এবার সাহিত্যে নোবেল কারা পেতে পারেন, তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই মত ছিল অনেক ধরণের। কবি মার্গারেট এটউড থেকে শুরু করে চাইনিজ লেখক ক্যেন শুয়ের মত অনেকেরই নাম কল্পনা করেছিল বিভিন্ন পশ্চিমা ম্যাগাজিন। বরাবরের মতই হালের জনপ্রিয় জাপানিজ লেখক হারুকি মুরাকামির নামও ছিল আলোচনায়। 'কাফকা অন দ্য শোর' বইটি প্রকাশের পর গত তেরো বছর ধরেই নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে মুরাকামির নাম উচ্চারিত হয়ে আসছে। এবছর সে আলোচনার তালিকায় যুক্ত ছিলেন সালমান রুশদিও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়নি কল্পনা।

ইয়ন ফসের নাটকের জনপ্রিয়তা নাট্য জগতে অনেক বেশি। ইতিহাসের বিখ্যাত নাটক লেখকদের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয়। তাই তার গদ্য যত না জনপ্রিয়, তারচেয়ে অনেক বেশি পরিচিত ফসের লেখা নাটকগুলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নাটকের পাশাপাশি তিনি গদ্যতেও মনোযোগ দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই নোবেল কমিটি ইয়ন ফসে সম্পর্কে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছেন, 'ইয়ন ফসেকে ভিন্নধর্মী নাটক এবং বলতে না পারা কথাগুলোকে কণ্ঠস্বর দেয়া জন্য ২০২৩ সালে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো'।

নোবেল পুরস্কার জেতা ইয়ন ফসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নরওয়েতে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী দেশগুলোর একটিতে জন্ম নেয়া ফসে সাত বছর বয়সে একটি দুর্ঘটনা থেকে ফিরে এসেছিলেন। হয়তোবা সে কারণে তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে আত্মহত্যা কিংবা মৃত্যু চিন্তার মত দার্শনিক বিষয়। ফসের প্রাথমিক পড়াশোনা হয়েছিল স্থানীয় বিদ্যালয়তেই। কৈশোর পেরিয়ে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অফ বার্গেনে। তুলনামূলক সাহিত্যের উপর পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস 'রেড ব্ল্যাক' (লাল কালো)।

নরওয়েজিয়ান কিংবদন্তী নাট্যকার হেনরিক যোহান ইবসেনের পরপরই উচ্চারিত হয় ইয়ন ফসের নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হেনরিক ইবসেন আধুনিক নাটকের প্রচার ঘটিয়েছিলেন। ইয়ন ফস যেন হেনরিকেরই ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন এই সময়ে। ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মত ইয়ন ফসের লেখা নাটক 'অ্যান্ড উই ইউল নেভার বি পার্টেড' (এবং আমরা কখনো বিচ্ছিন্ন হব না) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যেও বেশ কিছু রচনা আছে তার। গীতিকবিতা লেখার পাশাপাশি বেহালা বাজানোর ব্যাপারে ভালো দখল রয়েছে। বলা চলে, সব্যসাচী এই লেখকের মেধা সম্পর্কে এদিকের আলোচনা খানিকটা কম।

তবে বৈশ্বিকভাবে লেখক হিসেবে খুব একটা অপরিচিত বলা যাবে না ইয়ন ফসেকে। ২০০৭ সালের অক্টোবরে দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশ করা 'জীবন্ত ১০০ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব' শীর্ষক তালিকায় ছিল ফসের নাম। জাতীয়ভাবে সাহিত্যে ভূমিকা রাখায় ২০১১ সালে নরওয়ের রাজকীয় একটি বাসভবন সম্মানসূচক প্রদান করা হয় তাকে। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইডেন ও নরওয়ে নিয়ে গঠিত হওয়া নর্ডীয় রাষ্ট্রসমূহের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার 'নর্ডিক কাউন্সিল লিট্রেচার প্রাইজ' পুরস্কারটিও ২০১৫ সালে জিতে নেন ইয়ন ফসে। তার লেখা ইতিহাস আশ্রিত ত্রয়ী উপন্যাসের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাছাড়া গত বছর 'আ নিউ নেইম: সেপ্টোলজি' উপন্যাসটির জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত লেখকদের তালিকায় ছিল ইয়ন ফসের নাম।

গত কয়েক দশকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জেতা লেখকদের সিংহভাগই ঔপন্যাসিক। অন্যভাবে বললে, নোবেলজয়ী বেশিরভাগ লেখকই তাদের উপন্যাস দিয়ে পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু গত এক দশকে 'ঔপন্যাসভিত্তিক লেখক' থেকে বেরিয়ে এসেছে নোবেল কমিটি। অদ্ভুত হলেও পর্যবেক্ষণটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বোধ করি। কারণ ২০১৬ সালে বিখ্যাত গায়ক বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার পর গীতিকবিতা যে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। সাহিত্যের জনপ্রিয় ধারা উপন্যাসকে কেন্দ্র করেই সাধারণত সাহিত্য পুরস্কারগুলো দেয়া হয়ে থাকে। সে হিসেবে নাট্যকারদের সাহিত্যে অবদানের বিষয়টি বহুদিন ধরেই আলাপের জায়গা থেকে চাপা পরে আছে। এমনকি হালের বিভিন্ন সাহিত্য আয়োজনেও নাটক লেখা নিয়ে তেমন সভা-সেমিনার দেখা যায় না। ঢাকা লিট ফেস্টে অবশ্য একাধিকবার নাট্যকারদের নিয়ে আলাদা সভা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও দর্শকদের আগ্রহ ছিল তুলনামূলক কম। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন নাট্যকারকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়াটা, আধুনিক যুগের সাহিত্য চর্চা ও নোবেল পুরস্কার দুটি জায়গাতেই আলাদা একটি মাত্রা যোগ হয়েছে বলে বোধ করি।

ইদানীং কালে 'মিনিমালিজম' নামের ইংরেজি শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলায় এর সহজ অর্থ হলো, যা আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্যবান সেগুলোকে ধারণ করা এবং আমাদের জীবনের জন্য যেসব বিষয় খুব একটা দরকারি নয়; বরং এগুলো আমাদের দৃষ্টিকে অন্যদিকে নিয়ে যায়- জীবন থেকে এসব কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করা। ইদানীংকালে অনেকেই নিজের মত করে 'মিনিমালিস্ট লাইফস্টাইল' খুঁজে নিচ্ছেন। ইয়ন ফসের লেখায় নিজস্ব ঢঙের জীবনের একরকম দৃশ্যায়ন দেখা যায়। সাহিত্যের আলোচনায় গত কয়েক বছরে যেটিকে 'ফসে মিনিমালিজম' বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা দেয়ার সময় ইয়ন ফসে সম্পর্কে সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি নরওয়ের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের বিষয়গুলোর মধ্যে শৈল্পিকভাবে মিশেল ঘটিয়েছেন। এ কারণে তিনি নাট্যকারের পাশাপাশি আমাদের সময়ে ঔপন্যাসিক হিসেবেও নিজের স্বতন্ত্রতা দেখাতে পেরেছেন। তার আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পাওয়ার প্রথম ধাপটি ছিল ১৯৯৮ সালে প্যারিস প্রোডাকশনের প্রযোজনায় নির্মিত 'সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম' (কেউ একজন আসতে চলেছে) শীর্ষক নাটকের মাধ্যমে। তার লেখায় প্রচন্ডভাবে ফুটে ওঠে মানবিক দ্বৈতচিন্তা ও বিষাদ। যেটি তার লেখাকে অনেক বেশি সার্বজনীন করে তুলেছে।

পুরস্কার ঘোষণার সময় সংবাদ সম্মেলনে সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার কমিটির প্রধান আন্দ্রেয়াস ওলসন আগ্রহী পাঠকদের জন্য একাধিক বইয়ের পরামর্শ দেন।  যারা ইয়ন ফসের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন এবং জানেন না তার লেখা কোন বইটি পড়তে শুরু করা উচিত—তাদের উদ্দেশে ওলসন বলেছেন, তার সব কটি নাটকই অত্যন্ত সুখপাঠ্য। বড় কলেবরের লেখা পড়তে আগ্রহী পাঠকদের তিনি ১২৫০ পৃষ্ঠার সাতটি আলাদা বইয়ের এক আস্ত সিরিজ 'সেপ্টোলজি' পড়ার পরামর্শ দেন। এছাড়াও যারা ছোট কোন বই খুঁজছেন, তাদেরকে ২০০০ সালে প্রকাশিত উপন্যাসিকা 'মর্নিং অ্যান্ড ইভনিং' (সকাল সন্ধ্যা) নামক বইটি পড়তে বলেন ওলসন।

ইয়ন ফসের লেখায় ওঠে আসা সহজতর জীবনের যে 'মিনিমালিস্ট' পথে আমরা দেখতে পাই, সেখানকার পরিচিত বেদনা, অবসাদ কিংবা মৃত্যুর বিষয়গুলো হয়ে উঠেছে সার্বজনীন সাহিত্য। ফলে নরওয়ের মত সুখী দেশে বসেও নিজের লেখায় তিনি টেনে হিচড়ে নামিয়ে এনেছেন ইতিহাসের সুরঙ্গ। বের করে এনেছেন এমন জীবনের কথা, যা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় বহুদিন... 

Comments

The Daily Star  | English

Dozens of zombie firms still trading as if nothing is wrong

Nearly four dozen companies have been languishing in the junk category of the Dhaka Stock Exchange (DSE) for at least five years, yet their shares continue to trade on the country’s main market and sometimes even appear among the top gainers. 

1h ago