রবীন্দ্রস্মৃতি

শান্তিনিকেতনে বাইশে শ্রাবণের স্মৃতির বর্ষা

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বাইশে শ্রাবণ বাঙালির জীবনে স্মরণীয় দিন। দুঃখেরও। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে রাখী পূর্ণিমার এই দিনেই মহাপ্রস্থান ঘটে 'মরণজয়ী' রবীন্দ্রনাথের। বহুবিধ সৃষ্টির যে সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়েছিলেন কবিগুরু, সৃজনের সেই ধারাতেই তিনি এখনো বয়ে চলেছেন বাঙালির নিত্যকার জীবনধারায়। 

বিশ্বভারতীতে পড়াশোনার সুবাদে বেশ কয়েক বছর শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থাকার সুযোগ হয়েছে। পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ ছাড়াও যেখানকার প্রতিটি দিন উদযাপিত হয় রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। আজ এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য বাইশে শ্রাবণ উদযাপনের স্মৃতি। 

শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা হয়েছিল কবির ৬৪তম জন্মদিনে; ১৩৩২ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ। ওই বছর কবির আবাসস্থল উত্তরায়ণের উত্তর দিকের পথের ধারে 'পঞ্চবটী' প্রতিষ্ঠাই ছিল মূল লক্ষ্য। কবি রোপণ করেছিলেন অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক ও আমলকীর চারা।

কবির প্রয়াণের পর ১৯৪২ সাল থেকে প্রতিবছর বাইশে শ্রাবণের দিনে নিয়মিত বৃক্ষরোপণ উৎসব পালিত হয়ে আসছে শান্তিনিকেতনে।

কবির কথায়—পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিল। অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা কারণে নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবী ছায়াবস্ত্র হরণ করে তা নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হলো উত্তপ্ত। 

প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার জন্যই কবি বৃক্ষরোপণ উৎসবের ধারা তৈরি করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। এটি—অপব্যয়ী সন্তান কর্তৃক মাতৃভাণ্ডার পূরণ করবার কল্যাণ উৎসব। উৎসব শুরু হয় গানে গানে শোভাযাত্রার ভেতর দিয়ে। 

উপাসনা গৃহে সকালের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে উত্তরায়নে কবির পাঁচটি বাড়ির মধ্যে উদয়ন খুলে দেওয়া হতো। সেই বাড়িতে কবির ব্যবহার্য কতকিছু দেখার জন্য আমরা ছুটে গিয়েছি। হারিয়ে গিয়েছি তার পুরোনো সব ছবি আর স্মৃতির পাতায়।

শ্রাবণে শান্তিনিকেতনে ঘোর বর্ষা। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার যত গান, তার প্রতিটিই যেন শান্তিনিকেতনের ছবি। বর্ষায় সেখানে প্রকৃতির যে চিত্রের দেখা মিলত, তার প্রত্যেকটিই মনে করিয়ে দিত রবিঠাকুরের কোনো না কোনো গান। 

কবির ভাষায়—প্রকৃতি ঈশ্বরের শক্তির ক্ষেত্র, আর জীবাত্মা তার প্রেমের ক্ষেত্র। প্রকৃতিতে শক্তির দ্বারা তিনি নিজেকে প্রচার করেছেন, আর জীবাত্মায় প্রেমের দ্বারা তিনি নিজেকে দান করেছেন। 

কবি বর্ষার গানের মধ্য দিয়ে প্রেমের যে ধারা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন তা ঈশ্বরের দান। কবির গানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রেমশক্তির যে লীলা; তার অমৃত সুধা পেয়েছি, পাওয়ার দুর্লভ সাধনা করে চলেছি।

কবির চোখে বসন্ত যৌবনের দূত, শরৎ বার্ধক্যের আর বর্ষা বাল্যকালের। 

আমি শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলাম অর্থনীতিতে অনার্স করার পর। আমার বর্ষাকালের স্মৃতিতে শান্তিনিকেতন অনেক পরে এসে ধরা দিয়েছিল। ছোটবেলায় যদি পড়তে যেতে পারতাম, তাহলে সহজ পাঠের মতো করে হয়তো বর্ষাও আমার উপলব্ধিতে কত সহজ করে পেতে পারতাম! বড়বেলায় আমার চোখে শান্তিনিকেতনের বর্ষা-বসন্তের রূপই সেরা হয়ে আছে। 

ঢাকায় বর্ষা তেমন করে ধরা দেয় না সচরাচর। কবির মতো করে বলতে হয়—এখানে বর্ষা সমারোহ তেমন না, বর্ষাও ইকোনমিতে মন দিয়েছে। 

কবি বলেছিলেন—যারা শক্তির ক্ষেত্রে তাদের সমস্ত পাওয়াকে সীমাবদ্ধ করে রাখে তারা ঐশ্বর্যকে পায়, ঈশ্বরকে পায় না। কারণ ঈশ্বর সেখানে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে নিজের ঐশ্বর্যকে উদ্ঘাটন করেছেন। 

শান্তিনিকেতনে ঈশ্বর জীবাত্মায় প্রেম, আর প্রকৃতিতে শক্তি—দুটোই দান করেছেন। সেই প্রেম, সেই মোহিনী শক্তি দাও আমারে হৃদয় প্রাণ হরা! সেই প্রেম শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে…।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

4h ago