লেখকের বানান ও দায়িত্ব জ্ঞান 

প্রতীকী ছবিটি: সংগৃহীত

সিনেমা বিষয়ে এক ঘরোয়া আড্ডায় এক বন্ধু বললো- সিনেমার আর্টিস্টদের উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়া জরুরি না। কণ্ঠস্বর ভরাট হওয়ারও দরকার নেই। তার এমন বক্তব্যে আড্ডার অন্য বন্ধুরা বিস্ময় প্রকাশ করলো। এর মধ্যে একজন বললো- ভরাট কণ্ঠস্বরের কোনো বিকল্প আছে? তাহলে তুই কীভাবে বলিস সিনেমার আর্টিস্টদের কণ্ঠস্বর ভরাট হওয়ার দরকার নেই? আর এটা কীভাবে বলিস, তাদের উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়া জরুরি না? অশুদ্ধ উচ্চারণের সংলাপ কে শুনবে? এবার সেই বন্ধু বললো- তোরা দেখছি সিনেমার ব্যাপারে কিছুই জানিস না। আমি কার সঙ্গে আড্ডায় বসলাম হে? শোন অজ্ঞের দল, সিনেমায় 'ডাবিং' বলে একটা জিনিস আছে। যেটাকে সংক্ষেপে 'ডাব'ও বলে। ডাব মানে নারকেল গাছের ডাব না কিন্তু। হা হা হা। তো এই ডাব বা ডাবিং মানে হচ্ছে একজনের কণ্ঠ আরেকজনে দেওয়া। 

মোটকথা সিনেমার আর্টিস্টদের কাজ শুধু অভিনয় করে যাওয়া। উচ্চারণ শুদ্ধ, কণ্ঠস্বর ভরাট, এমন কাউকে দিয়ে ডাবিং বা ডাব করিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পরিচালকের। এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট আর্টিস্টের মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। ওইসব নিয়ে মাথা ঘামালে অভিনয় ভালো হবে না। ঘটনাটা বললাম এই জন্য, যেহেতু একই যুক্তি শোনা যায় সাহিত্য-বিষয়ক আড্ডা বা তর্ক-বিতর্কে। এখানে একদল জোরগলায় বলার চেষ্টা করে, লেখকদের বানানজ্ঞান থাকা জরুরি না। লেখক শুধু লিখে যাবেন। ভালো বানানজ্ঞান আছে, এমন কাউকে দিয়ে প্রুফ দেখিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব প্রকাশকের। বানান নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে লেখা ভালো হবে না। আরেকদল তো আরেক কাঠি সরেস। 

তাদের ধারণা এবং বক্তব্য- লেখকের বাক্যজ্ঞান থাকাও জরুরি না। বাক্যের শুদ্ধতা এবং সৌন্দর্য নিশ্চিত করবেন এডিটর বা সম্পাদক। মোটকথা, লেখক যে শুধু কষ্ট করে লিখছেন, তাতেই জগৎ-সংসার তার কাছে ঋণী থেকে যাচ্ছে। তার আর কোনো দায়িত্ব নেই, কর্তব্য নেই। আর কোনো যোগ্যতা থাকার দরকার নেই।

ব্যাপারটা আসলে তা না। সিনেমায় যারা নতুন অভিনয় করতে শুরু করেন, কেবল তাদের ক্ষেত্রেই ডাবিং প্রযোজ্য। আরও পরিষ্কার করে বললে, একটা ছেলে বা মেয়ে যখন সিনেমায় অভিনয়যাত্রা শুরু করে, তখন পরিচালকরা তার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠের ওঠা-নামা ইত্যাদির উপর সেভাবে ভরসা রাখতে পারেন না। তাই তাকে বলেন, তুমি শুধু অভিনয়টা করে যাও, বাকিটা আমরা করে নিচ্ছি। তখন এমন কাউকে দিয়ে ডাবিং করানো হয়, যার উচ্চারণ বিশুদ্ধ, বাচনভঙ্গি সুন্দর, কণ্ঠের ওঠা-নামা যথার্থ। কিন্তু এই নতুন ছেলেটা বা মেয়েটাই যখন কয়েকটা সিনেমা করে ফেলে, তখন এই বিষয়টা সে আর মেনে নেয় না। বরং অপমান বোধ করে। সে জানিয়ে দেয়, আমার ডাবিং আমিই করবো। তার মানে ডাবিং- এর একটা সময়সীমা আছে, একটা সমাপ্তি আছে। ওই অভিনয়শিল্পী প্রয়োজনে আবৃত্তির ক্লাসে ভর্তি হয়ে নিজের যোগ্যতা বাড়ান, তবু নিজের কণ্ঠ নিজেই দেন। 

অথচ লেখকদের বানান-সংক্রান্ত যোগ্যতা বাড়ানোর কোনো তাড়নাই নেই। তারা নতুন থেকে পুরনো হন, বইয়ের সংখ্যা বাড়ে, একসময় লেখালেখিতে ইস্তফা দেন। কিন্তু বানানজ্ঞান আর বাড়ে না। এর জন্য তারা যে অনুশোচনায় ভোগেন কিংবা এটাকে নিজেদের যোগ্যতার ঘাটতি মনে করেন, এমনও না। বরং তারা লেখকজীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনে করেন, বানান ঠিক করার দায়িত্ব প্রুফরিডারের। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন। প্রুফরিডারও তো মানুষ। তারও যোগ্যতার তারতম্য থাকতে পারে। তারও ভুল হতে পারে। তার ভুলটা ধরবে কে? কিংবা তার চোখ এড়িয়ে যাওয়া ভুল বানানটা শুদ্ধ করবে কে? প্রকাশক? প্রকাশক কেন বানান ঠিক করতে যাবেন? তার অন্যান্য দায়িত্বেরই তো শেষ নেই। 

তাহলে কি ভুলটা থেকেই যাবে? না, কোনো যুক্তিতেই ভুল থাকতে পারবে না। বইয়ে বানান ভুল থাকা 'ভুল' না; অপরাধ। হয়তো এই অপরাধের আইনি কোনো সংজ্ঞা বা ধারা নেই, তবে ক্ষতিকর দিক অবশ্যই আছে। আর এই ক্ষতির শিকার শুধু পাঠক হন না, লেখকও হন। যেহেতু ভুল বানানের কারণে অর্থ বদলে যায়। লেখক যা বলতে চান, তা বলা হয় না। বলা হয়ে যায় অন্যটা, ক্ষেত্রবিশেষে উল্টোটা। 'কী' এবং 'কি' নিয়েই কথা বলা যাক। 

একশোর মধ্যে পঁচানব্বইজন লেখকই জানেন না কোথায় 'কী' হবে, কোথায় 'কি' হবে। হয়তো তারা জানতে চাচ্ছেন কেউ একজন মাছ খাবে কি না। এক্ষেত্রে তাদের লেখার কথা- তুমি কি মাছ খাবে? কিন্তু লিখে বসে আছেন- তুমি কী মাছ খাবে? অর্থাৎ মাছ খাবে কিনা এটা জিজ্ঞেস না করেই জিজ্ঞেস করছেন কী মাছ খাবে। বড় না ছোট, রুই না বোয়াল। ওইদিন একজনকে উপদেশ দিতে দেখলাম- 'আর যা-ই করো, নিজেকে বেঁচে দিও না'। অথচ তিনি জানেন না, 'বেঁচে' দিও না হবে না। হবে 'বেচে দিও না'। বেচে দেওয়া এবং বেঁচে থাকা ভিন্ন জিনিস। তবে বানানজ্ঞান না থাকলে দুটোকে গুলিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক। ণ-ত্ব বিধান মানতে গিয়ে আমরা 'র' এর পরে 'ণ' লিখি। কিন্তু এটা জানতে চাই না, ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। 

যে কারণে অনেক লেখকই 'ধরন' লিখতে গিয়ে লেখেন 'ধরণ'। এদিকে 'কাপড় পরা'কে 'কাপড় পড়া' লেখার মহোৎসব তো সবসময়ই চলে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ওই যে বললাম বইয়ে বানান ভুল থাকাটা অপরাধ, তাহলে এই অপরাধের ঊর্ধ্বে থাকার উপায় কী? উপায় একটাই- লেখকের পর্যাপ্ত বানানজ্ঞান থাকা। মোটকথা, প্রুফরিডারের চোখ এড়িয়ে যাওয়া ভুলগুলো ধরে ফেলার যোগ্যতাটাও থাকতে হবে লেখকের। মনে রাখতে হবে, বানান ঠিক করাটা প্রুফরিডারের 'চাকরি'। 

লেখকের কিন্তু চাকরি না। এটা তার মর্যাদার বিষয়, ইমেজের বিষয়। ইমেজের প্রসঙ্গ যেহেতু চলেই এলো, এই বিষয়ে আরেকটু বলা যাক। বইয়ের কথা বাদ দিলাম, একজন লেখক যদি ফেসবুকে ভুল ইংরেজিতে স্ট্যাটাস দেন, তার ইমেজ থাকে? তাকে নিয়ে হাসাহাসি হয় না? তো ভুল ইংরেজি বললে বা লিখলে যদি একজন লেখক ইমেজ সংকটে পড়তে পারেন, তাহলে বাংলা ভুল লিখলে কেন তার ইমেজ অটুট থাকবে। তাও বইয়ে? যেখানে বই এবং ফেসবুকের ব্যবধান আকাশ-পাতাল! কেউ ভুল উচ্চারণে বক্তৃতা দিলে ছি ছি পড়ে যায়। আর লেখক ভুল বানানে পাণ্ডুলিপি তৈরি করবেন, বানানশুদ্ধির সব দায়িত্ব চাপিয়ে রাখবেন প্রুফরিডারের ঘাড়ে; এটা অযৌক্তিক। মনে রাখতে হবে, যুক্তিহীনতা কখনও, কোনোভাবেই দায়মুক্তির কারণ হয় না, হতে পারে না। 

লেখকের জমা দেওয়া পাণ্ডুলিপি  সম্পাদনার বিষয়টি বহুল প্রচলিত। এখানে কোনো অন্যায় বা অবৈধতা নেই। তবে এই বিষয়ে ভিন্ন ভাবনা মাথায় আসারও অবকাশ থেকে যায়। মনে করুন একজন লেখক তত ভালো লেখেন না। কিন্তু তার পাণ্ডুলিপি এমন কাউকে দিয়ে সম্পাদনা করানো হয়, যিনি অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন। তিনি এই লেখকের পাণ্ডুলিপির চেহারাই বদলে দেন। আর সেই বদলানো চেহারার পাণ্ডুলিপি যখন বই আকারে পাঠকের হাতে যায়, তখন তারা মুগ্ধ হন, তৃপ্ত হন। অপেক্ষা করেন পরবর্তী বইয়ের জন্য। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে অন্যভাবে, ভিন্ন কারণে। 

ধরা যাক কোনো কারণে এই সম্পাদকের সঙ্গে এই লেখকের সম্পর্কের অবনতি ঘটলো। সম্পাদক জানিয়ে দিলেন, এই লেখকের পাণ্ডুলিপিটি আর সম্পাদনা করবেন না। বা লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন এই সম্পাদককে দিয়ে আর সম্পাদনা করাবেন না। অথবা সম্পাদক মারা যেতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে পাণ্ডুলিপির কী হবে? পরিণতি দুটো হতে পারে। এক. লেখক যা লিখেছেন, হুবহু তা-ই আসবে বই আকারে। অর্থাৎ সম্পাদনা-বিহীন। দুই. অন্যকোনো সম্পাদক সম্পাদনার কাজটি সম্পাদন করবেন। এই দুই পরিণতিই ভয়ঙ্কর সম্পাদক-নির্ভর লেখকের জন্য। কেন ভয়ঙ্কর, বলছি। আপনি মুখের দাগ বা ব্রণ ঢাকতে ভারী মেকআপ ব্যবহার করেন। ভারী মেকআপ ছাড়া কারও সামনে যানই না। কিন্তু একদিন মেকআপম্যান না থাকার কারণে কিংবা মেকআপম্যানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার কারণে মেকআপ ছাড়াই গেলেন জনসম্মুখে। 

দেখবেন অনেকে আপনাকে চিনতেই পারছে না। যারা চিনছে, তারাও আপত্তিকর কথা বলছে মুখের দাগ আর ব্রণ নিয়ে। এতদিন যার পাণ্ডুলিপি নির্দিষ্ট সম্পাদক দ্বারা সম্পাদিত হয়ে পাঠকের হাতে গেল, সেই সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে ঘটনাটা ঠিক এমনই হবে। 

পাঠক বই পড়ে ভাববেন, লবণ একটু কম আছে, মরিচ একটু বেশি আছে, হলুদের অবস্থা যা-তা। অর্থাৎ এতদিন যে সবকিছু পরিমাণমতো থাকতো, স্বাদমতো থাকতো, সেটা আর নেই। এমতাবস্থায় এই লেখকের বইয়ের পাঠক কেবল কমতেই থাকবে। আর মুখে মুখে এই কথা ছড়িয়ে যাবে- অমুক লেখক আগে ভালো লিখতেন। এখন লেখার মান কমে গেছে। তার মানে এটাই তিক্ত বাস্তব- পরনির্ভরশীলতার পরিণতি ভয়াবহ। সেটা বানানের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে। তার মানে এই না যে, প্রুফরিডার প্রুফ দেখবেন না। অবশ্যই দেখবেন। তবে লেখককে বানানজ্ঞানশূন্য থাকলে চলবে না। প্রুফরিডারের চোখ এড়িয়ে যাওয়া ভুলটা ধরে ফেলার মতো যোগ্যতাও তাকে রাখতে হবে। 

আবার সম্পাদনার রেওয়াজটা বন্ধ হয়ে যাক, এমনটাও কোনো সুস্থ চাওয়া হতে পারে না। তবে শুধু সম্পাদকের উপর নির্ভর করা লেখকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই অন্ধকারকে হাজার মাইল দূরে রাখতে প্রত্যেক লেখকের উচিত হবে নিজের লেখা নিজে সম্পাদনা করার যোগ্যতা অর্জন করা। মনে রাখতে হবে, অজুহাত কখনো যোগ্যতার বিকল্প হতে পারে না।

Comments

The Daily Star  | English

15 army officers in custody taken to tribunal amid tight security

The International Crimes Tribunal-1 is set to review the progress of two cases of enforced disappearance

53m ago