‘জীবন মানেই ভাঙাগড়া’

নায়ক ফারুক,
নায়ক ফারুক। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ/স্টার

কেবল শহর নয়, গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন নায়ক ফারুক। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান ফারুক হলেও মানুষ ভালোবেসে তাকে ডাকতেন 'মিয়াভাই' বলে। গ্রামীণ গল্পের সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন তিনি। উপহার দিয়েছেন সাড়া জাগানো অনেক সিনেমা। জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননাসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন এই নায়ক।

২০১৫ সালের ১২ আগস্ট বিকেলে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম নায়ক ফারুকের উত্তরার বাসায়। সঙ্গে ছিলেন আলোকচিত্রী শেখ মেহেদী মোর্শেদ।

বাসায় পৌঁছেই দেখি, তিনি ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। সেলফ ভর্তি বই আর বই।

আমরা যেতেই বললেন, 'তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি, বসো।'

বললাম, ফারুক ভাই চলুন শুরু করা যাক...আগে ফটোশুট করি, তারপর সাক্ষাৎকার নেব।

হাসতে হাসতে বললেন, 'আরে বসো! ভাইয়ের বাসায় এসেছ, আগে গল্প হোক। খাওয়া-দাওয়া করো, তারপর ফটোশুট করব। সময় নিয়ে এসেছ তো?'

বললাম, সময় নিয়ে সমস্যা নেই। আমরা অনেক সময় নিয়ে এসেছি।

টেবিলে রাখা আস্ত মিষ্টির প্যাকেট আর দইয়ের হাঁড়ি দেখিয়ে বললেন, 'ভাইয়ের বাসায় এসেছ, কোনো সংকোচ করো না, আগে খাও। এরপর গল্প।'

তারপর সহকারীকে বললেন আমাদের খাবার দিতে।

আমরা অল্প খাচ্ছি দেখে বললেন, 'কী ব্যাপার, খাচ্ছ না কেন? তোমরা ইয়াংম্যান, এখনই তো খাবে। বুড়ো হলে তো খেতে পারবে না।'

বলে হাসলেন।

অনুরোধ রাখতে আরও দই ও মিষ্টি খেলাম।

জানতে চাইলেন, দই কেমন লেগেছে। বললেন, 'স্পেশাল দই, তোমাদের জন্য অর্ডার দিয়ে এনেছি। কোনোরকম সংকোচ করো না, যতটুকু পারো খাও।'

'ভাইয়ের বাসায় এসেছ'—এই কথাটি তিনি এতবার বললেন, মনে হলো এত বড় মাপের মানুষটি কত আপন করে নিচ্ছেন আমাদের।

দেয়ালের একাধিক ছবিতে চোখ পড়ল। বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার আর তার সাদা-কালো ও রঙিন পোর্ট্রেট ছবি।

নানা বিষয়ে গল্প করতে করতেই এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আমি ঘড়ি দেখায় বললেন, 'ভাইয়ের বাসায় আসবা, সময় নিয়ে আসবা না?'

বললাম, সময় নিয়েই এসেছি। কিন্তু সূর্য ডুবে গেলে ছবি ভালো আসবে না। তাই ঘড়ি দেখছি।

তখন বললেন, 'উপরে চলো আমার সঙ্গে। ওখানেই ছবি তুলব।'

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় পৌঁছাই। যেতে যেতে ভাবি, কত সিনেমা দেখেছি এই নায়কের। আজ তার বাসায় তারই সঙ্গে গল্প করছি।

দোতলার বসার রুমটা আরও সুন্দর। বড় বড় কয়েকটি ছবি দেয়ালে।

বেশ কয়েকটি ব্লেজার নিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন, 'বলো কোনটা পরব? কোনটায় ছবি ভালো আসবে?'

আমরা বললাম, আপনি সবগুলোই পরবেন একটা একটা করে। আজ অনেকগুলো ছবি তুলব। অনেকদিন হলো আপনার ফটোসেশন করি না।

হেসে সম্মতি দিলেন।

শুরুতে হালকা সবুজ রংয়ের একটি ব্লেজার পরলেন। সোফাসেটে বসে কিছু ছবি তুললেন। আলোকচিত্রীও একের পর এক ছবি তুলতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বললেন, 'আর কত ছবি তুলবে?'

আমি বললাম, তুলে রাখি ভাই। আবার কবে আপনাকে পাব...

তিনি বললেন, 'ভাইকে যখন ডাকবে তখনই পাবে। তোমাদের ক্ষেত্রে "না" নেই। আমার ক্যারিয়ারে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনেক।'

এরপর সহকারীকে চা-নাশতা দিতে বললেন। এরপর আবার পোশাক বদলে এসে বললেন, 'ওদিকে সুন্দর বারান্দা আছে। চলো বারান্দায় কিছু ছবি তুলব।'

তারপর বারান্দায় গেলেন। গাছ-গাছালিতে ভরা চমৎকার বারান্দা। বাতাসের তালে তালে গাছের পাতা দুলছে। পরিবেশটাও সুন্দর লাগছে।

এরপর তিনি টি-শার্ট পরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। আরও কিছু ছবি তোলা হয়।

ছবি তোলা শেষে আবার ড্রয়িংরুমে বসি সাক্ষাৎকারের জন্য। শুরুতেই জানতে চাই, আপনার বিপরীতে অনেক নায়িকা অভিনয় করেছেন। সবচেয়ে প্রিয় নায়িকা কে?

তিনি বললেন, ওভাবে বলা ঠিক হবে না। তাহলে কেউ কেউ কষ্ট পাবেন। কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। কবরীর বিপরীতে যেমন অভিনয় করেছি, ববিতার বিপরীতেও সিনেমা করেছি। সবার সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক ছিল।

এমন কোনো ঘটনা আছে নায়িকাদের নিয়ে যা মনে দাগ কেটে আছে? 

জবাবে নায়ক ফারুক বললেন, 'অনেক ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে। তবে, এই মুহূর্তে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। "সারেং বউ" সিনেমার শুটিং করতে গিয়েছিলাম আউটডোরে। একদিন জ্বর একশর বেশি, তারপরও শুটিং করেছি। পরের দিন জ্বর আরও বাড়লে শুটিং করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। ওদিকে কবরী শুটিং করবেই। তাকে শুটিং শেষ করে ঢাকায় ফিরতে হবে। কী আর করার। মন খারাপ করে জ্বর নিয়েই শুটিং শেষ করলাম। কবরী ওই রাতেই ঢাকায় ফিরে আসেন। পরে জেনেছিলাম—কবরী তখন সরোয়ার সাহেবের সঙ্গে প্রেম করছেন। সেজন্যই শুটিং শেষ করে ঢাকায় ফিরেছিলেন।'

এটা বলে হাসলেন কিছুক্ষণ।

জানতে চাইলাম, গ্রামীণ গল্পের চরিত্রের সঙ্গে এত সাবলীলভাবে মিশে গেছেন কীভাবে? 

চা খেতে খেতে বললেন, 'একজীবনে অভিনয়টাই করেছি। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে চেষ্টা করেছি। আর রাজনীতি করেছি, যাতে মানুষের কাছাকাছি যেতে পারি, তাদের জন্য কাজ করতে পারি।'

বললাম, আপনার কাছে জীবনের মানে কী? 

তিনি বললেন, 'দেখ, সিনেমা করে অনেক কিছু পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মানুষের ভালোবাসা। নয়নমনি, সুজন সখী-সহ অনেক সিনেমা মাসের পর মাস হলে চলেছে। সুপারহিট হয়েছে। জীবন মানে ভাঙাগড়া। একটা গান আছে না—নদীর একুল ভাঙে ওকূল গড়ে—জীবনটাও তাই।'

জানতে চাইলাম, নায়ক না হলে কী করতেন?

তৎক্ষণাৎ বললেন, 'রাজনীতি। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করছি। মানুষের জন্য কাজ করতে চাই, তাদের সেবা করতে চাই।'

গল্পে গল্পে সময় গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা। এবার ফেরার পালা। দরজা পর্যন্ত এলেন আমাদের বিদায় দিতে। বললেন, 'ভাইয়ের দরজা সবসময় খোলা। ইচ্ছে করলেই চলে এসো।'

নায়ক ফারুকের বাসা থেকে বের হয়ে সড়কে এসে ফের তাকালাম তার বাড়ির দিকে। মনে মনে ভাবলাম, নয়নমনি, গোলাপি এখন ট্রেনে, লাঠিয়াল-সহ কত জনপ্রিয় সিনেমার নায়ক এই বাড়িতে থাকেন! স্কুল পালিয়ে তার কত কত সিনেমা দেখেছিলাম। আজ সেই নায়কের সঙ্গে এতক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরছি।

আজ ১৮ আগস্ট এই নায়কের জন্মদিন। যদিও তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তিনি থেকে যাবেন আমাদের হৃদয়ে চিরদিন, ভালোবাসা-শ্রদ্ধায়।

Comments

The Daily Star  | English

SC Secretariat Ordinance: Judges may hold executive posts

Lower court judges will be able to hold executive positions in the law ministry as well as state entities even after the establishment of a Supreme Court secretariat aimed at keeping the judiciary free from the executive’s influence, says a draft ordinance.

4h ago