মুক্তির ৭৫ বছর পরেও যে সিনেমা দর্শককে ভাবায়, মুগ্ধও করে
অনেকে অতিরঞ্জন করে বলেন—'রাশোমন' শুধু জাপানের সেরা চলচ্চিত্র নয়, হয়তো সর্বকালের সেরা ছবি। এই দাবি যেমন তর্কসাপেক্ষ, তেমনি ছবিটির গল্পটিও অনেকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তবু একটি বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই—এটি খাঁটি সিনেমা ও এক ঐতিহাসিক সৃষ্টি।
এই সিনেমা জাপানের চলচ্চিত্রশিল্পের গতিপথ বদলে দিয়েছে। একইসঙ্গে আকিরা কুরোসাওয়াকে বিশ্বের মহান পরিচালকদের কাতারে তুলে এনেছে। আবার এটি একসঙ্গে খুনের রহস্য, আদালতের নাটক, অতিপ্রাকৃত ভয়ের গল্প, ঐতিহাসিক সময়ের ছবি, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ এবং গভীর দার্শনিক প্রশ্ন। মুক্তির ৭৫ বছর পরও ছবিটি দর্শককে ভাবায়, অস্বস্তিতে ফেলে, আবার মুগ্ধও করে।
রাশোমন ছিল এক বিশাল তোরণ। দুইতলা উঁচু। ছাদে ছিল সোনালি টালি। সিঁড়ি আর পাথরের সেতু মিলিয়ে এর কাঠামো ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। ১১০৭ সালের প্রথম দিনে মিনামোতো বংশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে কিয়োতোতে ফেরার সময় তাইরা মাসামি এই তোরণ ব্যবহার করেন বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। হেইয়ান যুগের শেষ দিকে এসে তোরণটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। বদনাম ছড়াতে থাকে। সেই সময় থেকেই এটি ভয়ংকর গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ডাকাতেরা এখানে আশ্রয় নিত। মহামারি আর দুর্ভিক্ষের সময় মৃতদেহ কবর না দিয়ে ছাদের ওপর ফেলে রাখা হতো। যেন আকাশই তাদের শেষ আশ্রয়। ছবির সংলাপেও এই লাশগুলোর কথা বলা হয়েছে।
দশম শতক থেকেই লোককথায় শোনা যায়, ওনি ইবারাকি-দোজি নামে এক ভয়ংকর দানব কিয়োতো শহরে তাণ্ডব চালাত। রাশোমন তোরণেই নাকি তার বাস ছিল। কিংবদন্তি সামুরাই ওয়াতানাবে নো সুনা শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে যুদ্ধ করে দানবটিকে তাড়িয়ে দেন। ছবির চিত্রনাট্যেও এই পরিচিত কাহিনির একটি ছোট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
জাপানের খ্যাতনামা লেখক রিউনোসুকে আকুতাগাওয়া তার ছোটগল্প 'ইন অ্যা গ্রোভ' বা 'ইয়াবু নো নাকা'-তে তোরণকে প্রতীকের মতো ব্যবহার করেন রাশোমন। এই গল্প থেকেই কুরোসাওয়ার রাশোমন ছবির জন্ম। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারিতে সাহিত্যপত্রিকা শিনচো-তে। তোরণের উল্লেখ গল্পটিকে দ্বাদশ শতকের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে। একইসঙ্গে এটি এমন কিছুর প্রতীক, যা কল্পনায় আছে, কিন্তু চোখে দেখা যায় না। আজ রাশোমন তোরণের কোনো চিহ্ন নেই। একটি ইটও অবশিষ্ট নেই। এর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানি কেবল পুরোনো নকশা, ছাপচিত্র, ইতিহাস, লোককথা আর ভৌতিক গল্প থেকে। ১৮৯৫ সালে যেখানে তোরণটি ছিল, সেখানে একটি ছোট স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। এখন জায়গাটি শিশুদের খেলার মাঠ। অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের কারণে সেখানে নতুন কোনো ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় না। ভাবলে অবাক লাগে—জাপানি হরর ছবির জন্য কী দারুণ জায়গা! এক অর্থে রাশোমন ছবিটিকেও সেই চোখে দেখা যায়।
'ইন অ্যা গ্রোভ' এবং সেই সূত্রে রাশোমন ছবির মূল ভাবনা হলো—আমরা যেসব বিষয়কে সত্য বলে জানি, তার বেশিরভাগই আমাদের নিজের দেখা নয়। আমরা তা জেনেছি অন্যের কাছ থেকে শোনা গল্পের মাধ্যমে। অর্থাৎ সত্য আমাদের কাছে আসে অন্যের চোখ দিয়ে। সেই চোখে থাকে বোঝাপড়া, পক্ষপাত, অভিজ্ঞতা আর অনেক সময় স্বার্থও। কেউ কেউ ইচ্ছা করেই গল্প বদলে বলেন, যাতে অন্যকে প্রভাবিত করা যায়। এই ভাবনাটি দার্শনিক ফ্রিডরিখ নীৎশের চিন্তার সঙ্গে মিলে যায়। নীৎশে বলেছিলেন, পৃথিবীকে আমরা যেমন বুঝি, তা আসলে ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার ফল। তার মতে, নিরপেক্ষ বা চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু নেই।
আমরা জানি, রাশোমন তোরণ কোথায় ছিল। কিন্তু কেউই তা নিজের চোখে দেখেনি। কেন এটি তৈরি হয়েছিল বা সেখানে আসলে কী ঘটেছিল—সবই আমরা জেনেছি অন্যের লেখা বা বলা কথা থেকে। আমরা বিশ্বাস করতে পারি, সামুরাই প্রভু তাইরা মাসামি এক যুদ্ধে জিতে বিজয় মিছিল নিয়ে এখান দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু খুব কম মানুষই বিশ্বাস করবে, আরেক প্রভু ওয়াতানাবে নো সুনা সেখানে এক দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—কোন গল্পটি আমাদের বেশি টানে?
চিত্রনাট্যকার শিনোবু হাশিমোতো 'ইন অ্যা গ্রোভ' গল্পটিকে অসাধারণ মনে করেছিলেন। তিনি এটিকে সিনেমায় রূপ দেওয়ার কঠিন দায়িত্ব নেন। গল্পটি এক ভয়াবহ ঘটনার পরের সময় নিয়ে। এক সামুরাই খুন হয়েছেন। তার স্ত্রী ধর্ষণের শিকার। কিন্তু আমরা ঘটনার সরাসরি বর্ণনা পাই না। বরং শুনি বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য। প্রত্যেকে নিজের মতো করে ঘটনাগুলো বলে। ডাকাত তাজোমারু (তোশিরো মিফুনে) নিজের অপরাধ স্বীকার করে। নারী মাসাকো (মাচিকো কিয়ো) নিজের যন্ত্রণার কথা বলেন। এমনকি মৃত সামুরাইও এক মাধ্যমে ভর করে নিজের গল্প শোনায়। প্রত্যেকের বয়ান একে অন্যের সঙ্গে মেলে না। ফলে সত্য কী—তা আর নির্ধারণ করা যায় না। প্রশ্ন ওঠে—আদৌ কি কোনো একক সত্য আছে?
আকিরা কুরোসাওয়া এই চিত্রনাট্যের খসড়া দেখেন দাইএই স্টুডিওর জন্য নতুন ছবি খুঁজতে গিয়ে। আগেই তার ছবি দ্য কোয়ায়েট ডুয়েল (১৯৪৯) সাফল্য পেয়েছিল। তিনি হাশিমোতোর সঙ্গে বসে চিত্রনাট্যটি আরও গুছিয়ে নেন। এটি ছিল তাদের দীর্ঘ সহযোগিতার শুরু।
শোনা যায়, কুরোসাওয়া তখন আতামির এক রিওকানে থাকতেন। একই জায়গায় ছিলেন ইশিরো হোন্ডা। তিনি লিখছিলেন তার প্রথম ছবি। দু'জন সারাদিন লিখতেন। রাতে একে অপরের লেখা পড়ে মতামত দিতেন। এইভাবেও রাশোমন সমৃদ্ধ হয়।
প্রথমে দাইএই ও তোহো—দুই স্টুডিওই ছবিটি করতে রাজি হয়নি। পরে কুরোসাওয়া গল্প সহজ করে আবার প্রস্তাব দেন। কম অভিনেতা। কম লোকেশন। কম বাজেট। শেষ পর্যন্ত দাইএই ছবিটির সম্ভাবনা বুঝতে পারে।
ছবির শুরুতেই দেখা যায় ভাঙাচোরা রাশোমন তোরণ। বৃষ্টি ঝরঝর করে পড়ছে। সেই তোরণের নিচে আশ্রয় নেয় এক পুরোহিত, এক কাঠুরে আর এক সাধারণ মানুষ। কাঠুরের প্রথম কথা—'আমি বুঝতে পারছি না'—এটিই যেন পুরো ছবির সারকথা।
এই তিনজনের কথোপকথনের ভেতর দিয়েই আমরা নানা গল্প দেখি। কিন্তু সবই আসলে স্মৃতির পুনর্গঠন। কেউ ভুল করতে পারে। কেউ ইচ্ছা করেও বদলে বলতে পারে। কুরোসাওয়া এখানে দেখান—দেখা মানেই বিশ্বাস নয়। প্রেক্ষাপটই সব। প্রশ্ন ওঠে শুধু সত্য নয়, বাস্তবতাকেও ঘিরে।
অভিনয়ে সবাই ভালো। তবে তোশিরো মিফুনে আলাদা করে নজর কাড়েন। তার তাজোমারু কখনো আত্মবিশ্বাসী বীর, কখনো কাপুরুষ ডাকাত। মাচিকো কিয়োর অভিনয়ও অসাধারণ। তার মাসাকো একদিকে ভাঙা, অন্যদিকে দৃঢ়।
চিত্রগ্রাহক কাজুও মিয়াগাওয়ার কাজ বিস্ময়কর। আলো, ছায়া, দূরত্ব— সবকিছু দিয়েই গল্প বলা হয়েছে। শেষে বৃষ্টি থামে। সূর্যের আলো আসে। অন্ধকারের মাঝেও আশার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
শেষ দৃশ্যটি মানবতার কথা বলে। মানুষ খারাপ হতে পারে। কিন্তু ভালো হওয়ার সুযোগ সব সময় থাকে।
৭৫ বছর পরও 'রাশোমন' অনন্য। এটি প্রত্যেক দর্শকের কাছে আলাদা বলে মনে হবে। কারণ মানুষের চোখে সত্য কখনো একরকম নয়।

Comments