ঢাকায় প্রতিবাদ জানানোর কোনো জায়গা নেই : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

তীব্র যানজটে দিশেহারা রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা। সিগন্যালে আটকা পড়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয় এখানে। এর মধ্যে প্রায়শই দেখা যায় ফুটপাতেই মোটরসাইকেল কিংবা অটোরিকশা তুলে দিতে। সম্প্রতি ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে ঢাকাতেই ন্যায্যদাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। পুলিশ গতকাল জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে সেই শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এমন করে নগরীতে আজ নানামুখী সংকট, একদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা, কর্মঘণ্টা-শ্রম নষ্ট, অন্যদিকে ন্যায্যদাবির আন্দোলন করার নির্দিষ্ট কোনো স্থানও এই শহরে নেই। ২০১৯ সালে এক অনুষ্ঠানে বিষয়গুলো নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন সম্প্রতি না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো ইমেরিটাস অধ্যাপক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
বেঙ্গল ইনস্টিটিউটের নগরনামা শিরোনামে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে দেওয়া সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের দেওয়া বক্তব্যটি তাদের চ্যানেল থেকে অনুলিখন করেন সুমন রেজা।
'আমার মতো একজন মানুষ, আমি অনেক সময় আপনভোলা হাঁটি। আমি হাঁটতে খুব পছন্দ করি। আমি চাই হাঁটার শহর। একটি শহর শুধু বসবাসের জায়গা নয় যে আপনি কাজ শেষে রাতে এসে ঘুমালেন, সকালে উঠে চলে গেলেন, তা তো না। এর সঙ্গে প্রতিদিন আপনার কথোপকথন চলে। শহরে যদি আমি আমার সমাজকে না পাই, যদি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক শহর এসে ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে শহর শুধুই বসবাসের একটি জায়গা হয়। আমরা তো সেটি চাচ্ছি না।
চলাচলের কথা উঠেছে, একজন মা কি তার সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে একটা রাস্তায় নামতে পারেন? আমি হাঁটতে হাঁটতে—আপনভোলা মানুষ, আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আলো জ্বলছে লাল, আমি থেমে গেলাম। কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল কোথায় যে আমাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে না? কারণ লাল মানে ঢাকায় থেমে থাকা নয়। আমি যখন যেখানে যে শহরে যাই, চেষ্টা করি যে শহরের মানুষগুলোকে এই সফট সিটি কনসেপ্ট যেটা আছে যেখানে প্রত্যেক মানুষের স্বপ্নের, পরিসরের চিন্তাগুলো জড়িত, সেগুলো বিষয় একটু সচেতন করতে।
এই শহরের কোনো ফুটপাত চলাচলযোগ্য নয়। এই শহরে একটি পাবলিক স্কয়ার নেই। পৃথিবীর সবখানে প্রতিবাদ জানানোর জন্য, মানুষ সমবেত হওয়ার জন্য বা উৎসব উদযাপনের জন্য একটি স্কয়ার থাকে, এর প্রয়োজন হয়। আমাদের ঢাকায় প্রতিবাদ জানানোর কোনো জায়গা নেই। আমরা শুধু নির্মাণ করছি, আমাদের মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের পানিকে শেষ করে দিয়েছি। পানি আমাদের প্রকৃতির অঙ্গ, পানি যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে জীবনের অন্যান্য কোলাহল শেখানোর অনুষঙ্গও অনুপস্থিত।
পৃথিবীর যেকোনো শহর তিনটি নদী নিয়ে আহ্লাদে ফেটে পড়তো। তিনটা নদীকে কীভাবে এই শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, সেই চিন্তা-ধারাতেই তারা নামত। কিন্তু আমরা তিনটি নদী দখল করছি, দূষিত করছি। একটা নদী নেই যার পাড়ে আপনি বসে আকাশ দেখতে পারেন। আমরা নদীর পাড়গুলোকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছি। কিছু গুদামের হাতে, কিছু অসৎ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছি। নদীকেও তো আমরা ব্যবহার করতে পারতাম যাতায়াতের জন্য।
ঢাকা বললে সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের কথা মনে আসে, নারায়ণগঞ্জের কথা মনে আসে, সিলেট যে শহরে আমি বড় হয়েছি অসাধারণ সুন্দর একটি শহর ছিল, এখন এত ঘিঞ্জি যে শহরে আর ঢোকা যায় না। আমি এখন ভয় পাই সে শহরে যেতে। সব ঢাকাকে অনুকরণ করছে।
আমি তো একজন নাগরিকের পক্ষে কথা বলছি। আমি নিশ্চিত আপনারা প্রত্যেকেই আমার কথাগুলোকে প্রতিধ্বনি করবেন। সেদিন একজন মানুষ, নারী বা পুরুষের কথা বলছি না—একজন মানুষ এই শহরটাকে নিজের বলে দাবি করতে পারবে, নিজের বলে কখন দাবি করব? যখন এই এ শহরের সঙ্গে আমার একটা প্রাণের সম্পর্ক স্থাপিত হবে, আমি গান গেয়ে পথ পার হয়ে যাব, আমি রাস্তা দিয়ে নেমে আত্মভোলা মানুষ, দুই দিকে যানবাহন থেমে যাবে, একটি মানুষ গান গেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, তাকে সম্মান জানিয়ে নগরে যত যান আছে তা বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য, যেদিন আমরা অর্জন করতে পারব আমার মনে হয় সেদিন এই সমস্যাগুলো আমাদের থাকবে না।
প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আমার অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন সেটি হবে না আমার মনে হয় ঢাকা নিয়ে শুধু আমরা কল্পনাই করে যাব এবং দুঃখ পাব। দিনশেষে আমাদের কল্পনাগুলো অলীক কল্পনায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
শুধু আমরা সচেতন হলে চলবে না, একটা রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা লাগবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে, মানুষের সদিচ্ছা লাগবে, সমাজের সদিচ্ছা লাগবে। সবগুলো সদিচ্ছাকে একটা জায়গায় আমি একাত্ম করব, সে শক্তিটা আমরা কোথা থেকে পাব?
আমি বস্তুত, আমার জীবনকালে এই ঢাকা শহরকে নতুনভাবে সাজতে দেখব না?'
Comments