শেরেবাংলা ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের দুষ্প্রাপ্য দলিল

যুক্তফ্রন্টের অন্যতম সক্রিয় নেতা এবং বামপন্থী রাজনীতিক মোহাম্মদ তোয়াহা প্রার্থী নির্বাচনের অসুবিধা নিরসনেরপরামর্শ চেয়ে যুক্তফ্রন্ট প্রধান শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হককে চিঠি লিখেছেন। ছবি : লেখক

অনেকটা অগোচরেই যখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পেরিয়ে এ বছর ১৫২তম জন্ম বছর চলছে এবং এর প্রাক্কালে যখন তাকে নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি, ঠিক বিডি হাবিবুল্লাহ্'র মতোই বলতে হচ্ছে, এই ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে তার মতো একজন মহামানব সম্পর্কে লেখা আদৌ কি সম্ভব? সম্ভব হলেও এত দিগন্ত বিস্তৃত মানবের কোন অংশ থেকে শুরু করে কোথায় বা শেষ করব, তা ঠাহর করা দুরূহ বিষয়।

শেরে বাংলাকে মুখ্য করে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে তার কাছে পাঠানো বেশ কিছু চিঠি, টেলিগ্রাম, প্রার্থী নির্বাচনের প্রস্তাবনা, যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী তালিকাসহ সে সময়ের বেশ কিছু দলিলাদি উদ্ধারের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আমি জড়িয়ে যাই। কীভাবে সেগুলো খুঁজে পেলাম, সেই চমকপ্রদ ঘটনা আপনাদের উদ্দেশ্যে লিখছি—

বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিভাগে কাজ করতাম, সেই বিভাগের একটা অংশ অবলুপ্ত ব্যাংক মনিটরিং উপবিভাগ। তখন কাজের দায়িত্ব হিসেবে এই উপবিভাগের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। সেই উপবিভাগের মূল কাজ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের কিছু ব্যাংক, যেগুলো মূলত ব্রিটিশ ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় অবলুপ্ত হয়ে গেছে, সেসব ব্যাংকের সম্পদ (যদি পাওয়া যায়) দেখাশুনা করা। পাশাপাশি অবলুপ্ত ব্যাংকগুলোর অনেক পুরোনো নথি এবং দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষিত আছে, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা যে, কোনো অনুদ্ধারকৃত সম্পত্তি এসব ব্যাংকের রয়েছে কি না। যদি সে ধরনের কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা করা। আমাদের বিভাগে এসব পুরোনো কাগজপত্রের অনেক আলমারি, বস্তা ও বাক্সপ্যাটরা আছে, যেগুলো মাঝেমধ্যেই এই কারণে খুঁজে দেখা হয়। বিভাগের একটা ডেডিকেটেড টিমও আছে যাদের মূল কাজ এই খোঁজাখুঁজি। সেই টিমের একজন সদস্য আরিফুল ইসলাম, যিনি আমাদের বিভাগের সিনিয়র ডেটা এন্ট্রি কন্ট্রোল অপারেটর (ডেকো)। আরিফ সাহেবই প্রথম এই চিঠি খুঁজে পান এবং একটি চিঠি আমার কাছে নিয়ে আসেন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় প্রার্থী-সম্পর্কিত বিষয় তুলে ধরে এ. কে. ফজলুল হককে চিঠি লিখেছেন নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের যুক্তফ্রন্ট সম্পাদক জয়নুল আবেদীন, ছবি : লেখক

চিঠি পড়ে বুঝতে পারি এটি চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময়কার শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে লিখিত নির্বাচন সংক্রান্ত চিঠি। লেখক আবু মোহাম্মদ তোয়াহা। তোয়াহা নামটা আমার খুব পরিচিত লাগল। জানা ছিল এই নামে একজন রাজনীতিক ছিলেন। নিশ্চিন্ত হতে গুগলে বেরিয়ে আসল আবু মোহাম্মদ তোয়াহার নাম। বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ, যিনি নিজেও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় একজন প্রার্থী ছিলেন। তিনি জয়ী হয়েছিলেন এই নির্বাচনে।

আরিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম—কই পেলেন এই চিঠি? তিনি জানালেন, ১২তলায় আমাদের পুরোনো কাগজপত্রের সঙ্গে একটা বস্তার ভেতরে ছিল। আরও অনেক চিঠি আছে বলেও জানালেন। শেরেবাংলার সই করা চিঠিও আছে একটা। আমার টনক নড়ল। বললাম, চলেন দেখি চিঠিগুলো কই আছে। সেগুলো উদ্ধার করি। একপ্রকার দৌড়ে ১৬তলা থেকে ১২তলায় নামলাম। সেখানে আমাদের যে পিয়ন কাজ করছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলাম চিঠিগুলোর বিষয়ে। চিঠিগুলো কই? পিয়ন জানাল এগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

খুব মন খারাপ হলো। কাগজপত্র ছিঁড়ে যে ডাস্টবিনে ফেলা হয়, সেখানে ছুটলাম। গিয়ে দেখি কিছু ছেঁড়া কাগজপত্র আছে। তবে আমার কাঙ্ক্ষিত সেই ধরনের চিঠি নেই। ছেঁড়াখোঁড়া কিছু পাওয়া গেলে তাও তো তালিটালি দিয়ে চেষ্টা করে দেখা যেত সেগুলোর পাঠোদ্ধার করা যায় কি না। খুব হতাশা পেয়ে বসল। ইশ! হাতের কাছে পেয়েও কি ঐতিহাসিক মূল্যবান জিনিস হারালাম। অবশ্য তার একটু পরেই আমাদের পিয়ন মমিন জানালেন, স্যার আপনি যে কাগজগুলো খুঁজছিলেন, সেগুলো পাওয়া গেছে।

শামীম, মানে আমাদের আরেক পিয়ন আরিফ সাহেবের কথামতো সেগুলো সরিয়ে রেখেছিল। যাক অবশেষে পাওয়া গেল। দ্রুত সেগুলো এনে পরীক্ষা করলাম কী কী আছে। শুধু চিঠি না, তার সঙ্গে অনেকগুলো টেলিগ্রাম, কিছু লিফলেট এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করার জন্য একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটির দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন প্রার্থী সম্বন্ধে সবরকম তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন দাখিল করা, সেই ধরনের কয়েকটি গোপনীয় প্রতিবেদন। এসব চিঠি, টেলিগ্রাম ও গোপনীয় প্রতিবেদন—সবই পাঠানো হয়েছে শেরেবাংলাকে উদ্দেশ্য করে।

অবশ্য আরিফ সাহেব দাবি করলেন যে আরও অনেক চিঠি ও কাগজপত্র ছিল। তা ছাড়া শেরেবাংলার সই করা চিঠিও নাকি ছিল। তবে শেরেবাংলার সই করা চিঠি ছিল—এই দাবি মানতে আমার মন সায় দেয়নি। কারণ চিঠিপত্র যেগুলো পাওয়া গেছে, সবই তার কাছে লিখিত। অর্থাৎ বোঝাই যায় এগুলো শেরেবাংলার কাছে এসেছে। যে চিঠিগুলো তিনি লিখেছেন বা সই করেছেন, সেগুলো তার কাছে থাকার সুযোগ নেই। কারণ সেগুলো যাদের উদ্দেশে লিখেছেন, তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে আরও কাগজপত্র ছিল কি না, কিংবা কিছু ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে কি না, তা সম্পর্কে অবশ্য জানতে পারিনি। পিয়ন যারা ছিল, তারা সবাই দাবি করেছে যে, চিঠিপত্রসহ যে কাগজগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো এগুলোও। এর বাইরে কিছু ছিল না। অবশ্য আমি যা পেয়েছি তাতেই খুশি।

প্রশ্ন হলো—যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের এসব চিঠিপত্রসহ কাগজগুলো এই বিভাগে এলো কীভাবে? তাহলে কি শেরেবাংলার সঙ্গে এই বিভাগের কোনো সম্পর্ক আছে? কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিভাগের সঙ্গে শেরেবাংলার সরাসরি বা প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই। তবে একপ্রকার সম্পর্ক আছে, যা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৭ সালে অফিসিয়াল লিকুইডেটর হিসেবে অবলুপ্ত ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব পায়। তবে এর আগে এই ব্যাংকগুলোর অফিসিয়াল লিকুইডেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন আইনজীবী। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। ১৯০০ সালে ফজলুল হক কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। তবে তার কিছুদিন পরেই প্রোমোশন সংক্রান্ত বিষয়ে তার প্রতি অবিচার হওয়ায় এবং রাজনৈতিক কারণে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আবার আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।

১৯৫৩ সালে যখন পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করা হলো, তখন তিনি ঢাকা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন। সুতরাং হাইকোর্ট বিভাগের যিনি বা যেসব আইনজীবী অবলুপ্ত ব্যাংকগুলোর অফিসিয়াল লিকুইডেটর হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে কারও কারও শেরেবাংলার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা খুব স্বাভাবিক। তা ছাড়া এমনও হতে পারে যে, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো কৃষক-শ্রমিক পার্টির সদস্য কিংবা যুক্তফ্রন্টের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাদের কারও কাছ থেকে কোনো না কোনোভাবে হয়তো অবলুপ্ত ব্যাংকের বিভিন্ন দলিলাদির সঙ্গে এসব চিঠি এবং কাগজপত্র ভুলক্রমে চলে এসেছে। তবে এসবই ধারণা মাত্র! আমরা শুধু এ বিষয়ে অনুমান করতে পারি।

প্রাপ্ত চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, লিফলেট ও অন্যান্য নথিপত্রের প্রাসঙ্গিকতা

প্রাপ্ত ডকুমেন্টগুলোর মধ্যে চিঠি, টেলিগ্রাম, ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট, বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঠানো সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা, যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা, লিফলেট পাওয়া গেছে। এসব চিঠি, টেলিগ্রাম, লিফলেট ও ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে। এই উপমহাদেশের বিগত শতাব্দীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী যেসব রাজনীতিবিদ ছিলেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তাদের মধ্যে অন্যতম। অবিভক্ত ভারতে একইসঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিরল সম্মান তিনি লাভ করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপকসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাকে প্রভাবিত করেছেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আমাদের জাতীয় নেতা এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালির প্রথম সফল রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্টের তিন নেতার অন্যতম।

শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন—একে অপরের পরিপূরক। তাকে কেন্দ্র করেই মূলত যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। মূলত ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের জগদ্দল অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে এবং পূর্ব বাংলায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনকে ঘিরে গড়ে উঠছিল এ রাজনৈতিক জোট। এ জোটের পেছনে প্রধান নিয়ামক শক্তি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক চেতনা। পাকিস্তান পর্বের শুরু থেকেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ করার কারণে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল সে জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশে জোট রাজনীতির প্রসঙ্গ এলেই ১৯৫৪ সালের 'যুক্তফ্রন্ট' দিয়েই আলোচনার ডানা মেলতে হয়।

আদর্শিক ও মূল্যবোধগত বিরোধ সত্ত্বেও সাধারণ শত্রু হিসেবে মুসলিম লীগকে মোকাবিলার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, বামপন্থী, উদার ও রক্ষণশীল ইসলামপন্থী সব ধরনের রাজনৈতিক দল। ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের 'যুক্তফ্রন্ট' নামের নির্বাচনি জোট নানা ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলার তিন অবিসংবাদিত নেতা নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির (কেএসপি) সভাপতি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সমন্বয়ে মূলত যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলেও পরবর্তী সময়ে জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, পাকিস্তান খেলাফত পার্টি এবং মওলানা আতাহার আলী নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম পার্টি। নেজামে ইসলাম পার্টি যুক্ত হয়েছিল কৃষক-শ্রমিক পার্টির সঙ্গে পৃথকভাবে ১০ দফা চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে, যা নিয়ে জোটের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ফজলুল হককে। রক্ষণশীল নেজামে ইসলাম পার্টিকে জোটে অন্তর্ভুক্তির কারণে জোটের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক উদারনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন অনেকে।

নানা আদর্শিক ও মূল্যবোধগত বিরোধ সত্ত্বেও সাধারণ শত্রু হিসেবে মুসলিম লীগকে মোকাবিলার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, বামপন্থী, উদার ও রক্ষণশীল ইসলামপন্থী সব ধরনের রাজনৈতিক দল। ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের 'যুক্তফ্রন্ট' নামের নির্বাচনি জোট নানা ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। ২১ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সে নির্বাচনি জোট গঠনে রাজনীতিবিদদের প্রেরণা জুগিয়েছিল তৎকালীন ছাত্রসমাজ।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহার এবং ২১ দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিকাশমান মধ্যবিত্ত, স্বনির্ভর কৃষক এবং শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের কর্মসূচি। কারও কারও মতে পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য অভিজাত মুসলিম ও বুর্জোয়া শ্রেণি এবং সামরিক শাসকদের বিপরীতে পূর্ব বাংলার নব্য 'এলিট শ্রেণির' কর্মসূচি ছিল ২১ দফা। ইশতেহারে পূর্ব বাংলার শিক্ষা, কৃষি ও শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার আশ্বাস যেমন ছিল, তেমনি ছিল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও।

২১ দফার ১৯তম দফা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারে বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্রবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অভাবনীয় বিজয় অর্জন করে। যুক্তফ্রন্ট সরকার খুব ক্ষণস্থায়ী হলেও ইতিহাসে এ নির্বাচনি জোটের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রথম সম্মিলিত দাবি তুলেছিল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একচেটিয়াভাবে ভোট দিয়েছিল মুক্তির আশায়।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ছিল ইতিহাসের এক উত্তাল সময় এবং এর কেন্দ্রে ছিলেন শেরেবাংলা। যে চিঠিপত্র তার কাছে এসেছে, সেগুলো সবই নির্বাচন কেন্দ্রিক। প্রাপ্ত চিঠি টেলিগ্রাম, রিপোর্ট ও লিফলেটের বিষয় ছিল যুক্তফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর মুসলিম লীগ সমর্থক এবং প্রশাসনের অত্যাচার, প্রচার-প্রচারণা, এলাকায় প্রার্থীদের অবস্থা, প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য পার্টির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য, প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য ইত্যাদি। তা ছাড়া সেই নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম-আন্দোলনের চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে যেসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনমত গঠন এবং প্রচার-প্রচারণার জন্য কর্মী শিবির গঠন, ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের আর্জি, মনোনয়ন বঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ, রাজনৈতিক বিভেদ, সর্বোপরি মানুষের প্রত্যাশার চিত্র দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া শেরেবাংলার প্রতি তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ জনগণের যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তি, তাও দারুণভাবে ফুটে উঠেছে এই চিঠিগুলোতে।

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে ঘিরে অনেক বই রচিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অংশগ্রহণ নিয়ে তেমন কোনো দলিল বা নথির খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার যেকোনো অজানা গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের খোঁজ পাওয়া মানে সেই ঘটনা সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা ও ভাবার সুযোগ আসা। সেই সময়ের এসব চিঠি, লিফলেট, রিপোর্ট ও পোস্টারগুলোর মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের সংশ্লিষ্ট ঘটনার সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়েছি, যেন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে।

Comments