২৫০ বছর পরেও কেন প্রাসঙ্গিক সাহিত্যিক জেন অস্টেন

জেন অস্টেন, ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে নারী লেখকদের মধ্যে যদি কাউকে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও কালজয়ী বলা যায়, তবে নিঃসন্দেহে সেই নাম জেন অস্টেন। এ বছর তার ২৫০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এতো বছর পরও তিনি কেন প্রাসঙ্গিক?

তার রচনাকাল ও চিন্তার পরম্পরা আমাদের নানাভাবে ভাবায়। তিনি জীবদ্দশায় ছয়টি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখেছিলেন। তবে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সাহিত্য প্রতিভার প্রকৃত স্বীকৃতি পাননি। মৃত্যুর পর দুই শতাব্দীতেও তার জনপ্রিয়তা এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, তাকে এখন বিশ্বসাহিত্যের স্মরণীয় নাম হিসেবেই গণ্য করা হয়।

অস্টেনের উপন্যাসগুলো একদিকে ১৮০০ ও ১৯০০ শতকের ইংল্যান্ডের উচ্চবিত্ত সমাজের জীবনচিত্র তুলে ধরে, অন্যদিকে এগুলো এমন মানবিক সত্যকে প্রকাশ করে, যা আজও পাঠককে সমানভাবে স্পর্শ করে। প্রেম, সামাজিক শ্রেণি, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্ন—এসব তার লেখায় যেন কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে।

জীবন ও বেড়ে ওঠা

অস্টেন জন্মগ্রহণ করেন ১৭৭৫ সালে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের স্টিভেনটনে। তিনি ছিলেন রেভারেন্ড জর্জ অস্টেন ও কাসান্দ্রা অস্টেন দম্পতির আট সন্তানের মধ্যে সপ্তম।

তাদের পরিবারে বই পড়ার পরিবেশ ছিল প্রখর। তার বাবা ছিলেন একজন জ্ঞানী ধর্মযাজক এবং তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল সমৃদ্ধ। সেই লাইব্রেরিই মূলত অস্টেনের শিক্ষার প্রধান উৎস।

পরবর্তীতে পরিবার যখন বাথ শহরে চলে আসে, অস্টেন সেখানে স্বস্তি পাননি। ১৮০৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি, তার মা ও বোন কাসান্দ্রা আর্থিকভাবে পুরুষ আত্মীয়দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

অবশেষে ১৮০৯ সালে তারা চটন গ্রামে একটি সাধারণ কুটিরে বসবাস শুরু করেন। এই ছোট্ট বাড়ির ছোট্ট ডাইনিং রুমের একটি টেবিলে বসেই অস্টেন তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলো লিখেছিলেন। বর্তমানে কুটিরটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত।

সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য ও রীতি

অস্টেনের উপন্যাসগুলোকে অনেকে কেবল রোমান্টিক কাহিনী ভেবে ভুল করেন। কিন্তু, তার রচনায় প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও শ্রেণিবিভাগের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ।

বিশেষ করে তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো 'স্বাধীন পরোক্ষ উক্তি' নামক বর্ণনাশৈলীর ব্যবহার। এই কৌশলে লেখক সর্বজ্ঞ তৃতীয় পুরুষ বর্ণনার মধ্যেও চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত চিন্তা ও বক্তব্যকে প্রতিফলিত করেন।

ফলে পাঠক একই সঙ্গে চরিত্রের ভেতরকার দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখকের ব্যঙ্গাত্মক নিরপেক্ষতা অনুভব করতে পারেন। আধুনিক উপন্যাস সাহিত্যে এই কৌশল এখন সাধারণ হলেও অস্টেনই এটিকে সুসংহত ও জনপ্রিয় করেছিলেন।

তার রচনায় যে বৈশিষ্ট্যগুলো সবচেয়ে স্পষ্ট সেগুলো হলো—

তীক্ষ্ণ রসবোধ ও ব্যঙ্গ

শ্রেণিবিভাগ ও ভণ্ডামির সমালোচনা

নারীর দুর্বল অবস্থানের বাস্তব চিত্র

অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার কঠিন বাস্তবতা

প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস: এক অমর সৃষ্টি

যদি অস্টেনের একটি মাত্র বই পড়ার পরামর্শ দিতে হয়, তবে নিঃসন্দেহে 'প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস' বেছে নিতে হয়। ১৮১৩ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তায় অস্টেনকে চূড়ায় পৌঁছে দেয়।

গল্পটি আবর্তিত হয়েছে বেনেট পরিবারের পাঁচ কন্যাকে ঘিরে। মূলত, এলিজাবেথ বেনেট ও ধনাঢ্য কিন্তু অহংকারী মিস্টার ডার্সির প্রেমঘটিত দ্বন্দ্ব ও সমাধানকে কেন্দ্র করে। এখানে একদিকে প্রেমের টানাপড়েন, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক ব্যবধানের প্রতিফলন স্পষ্ট।

বিখ্যাত নাট্যকার রিচার্ড ব্রিন্সলি শেরিডান এই বই পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, এটি তার পড়া সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত রচনা। অস্টেন নিজেও বোনকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তিনি এলিজাবেথ বেনেট চরিত্রকে নিজের সৃষ্ট সেরা চরিত্রগুলোর মধ্যে গণ্য করেন।

নারীর অবস্থান ও অস্টেনের দৃষ্টিভঙ্গি

অস্টেনের সময়কার ইংল্যান্ডে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রায় অসম্ভব ছিল। বিয়েই ছিল তাদের নিরাপত্তার একমাত্র উপায়। তার উপন্যাসগুলোয় এই বাস্তবতাই নানা আঙ্গিকে প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নারীরা স্বামী বেছে নিতে গিয়ে কেবল ভালোবাসার কথা ভাবতে পারত না; আর্থিক স্থিতি ও সামাজিক অবস্থানও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অস্টেন নিজে বিয়ে করেননি। যদিও টম লেফ্রয়ের সঙ্গে তার তরুণ বয়সের প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল। আবার হ্যারিস বিগ-উইথার নামক এক ভদ্রলোকের প্রস্তাবও তিনি প্রথমে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু পরদিনই প্রত্যাখ্যান করেন।

অস্টেন তার এক ভাগ্নিকে লেখা চিঠিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, 'যদি সত্যিই ভালো না লাগে, তবে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। ভালোবাসা ছাড়া বিয়ে করার চেয়ে কষ্টকর কিছু নেই।'

এই বক্তব্য তার নারী স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রতিটি পাঠক অস্টেনের উপন্যাস থেকে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কেউ পড়েন বিবাহকেন্দ্রিক প্লটের জন্য, কেউ তার সূক্ষ্ম রসিকতা ও ব্যঙ্গরসের জন্য, কেউ আবার সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা খুঁজে পান। যে দিক থেকেই দেখা হোক, তার রচনা পাঠকের মনে আনন্দ ও চিন্তার খোরাক যোগায়।

অস্টেনের জীবনের শেষ আট বছর বাড়িটিতে কেটেছিল, ছবি: সংগৃহীত

অস্টেনের বিশেষত্ব হলো, তিনি একটি জটিল ও বিরক্তিকর পরিস্থিতিকেও এমনভাবে চিত্রিত করেন যে, পাঠক হাসির মাধ্যমে তা উপলব্ধি করতে পারে। হয়তো এ কারণেই তার লেখা আজও নতুন পাঠককে আকৃষ্ট করে।

অস্টেনের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

অস্টেন মাত্র ৪১ বছর বয়সে ১৮১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় তিনি ব্যাপক স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু, মৃত্যুর পর তার রচনা ক্রমে ইংরেজি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়।

আজ জন্মের ২৫০ বছর পরও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার উপন্যাস পড়া হয়, গবেষণা করা হয়, চলচ্চিত্র ও নাটকে রূপান্তরিত হয়। তাকে নিয়ে অসংখ্য সমালোচনা, জীবনী ও একাডেমিক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।

অস্টেন ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা, যিনি জীবদ্দশায় সীমিত স্বীকৃতি পেলেও মৃত্যুর পর হয়ে উঠেছেন কালজয়ী সাহিত্যিক। তার উপন্যাসে যেমন আছে প্রেমের চিরন্তন আকর্ষণ, তেমনি আছে সমাজের কঠিন বাস্তবতার বিশ্লেষণ। ব্যঙ্গ, কৌতুক, গভীরতা ও মানবিক সত্যের সমন্বয়ে তার রচনা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

২৫০ বছর পরও পাঠক যখন এলিজাবেথ বেনেট ও মিস্টার ডার্সির সম্পর্কের টানাপড়েন পড়েন, তখন মনে হয় যেন এই গল্প আজকের সমাজেও ঘটে যেতে পারে। এটাই অস্টেনের সাহিত্য প্রতিভার মূল শক্তি—যা সময়কে অতিক্রম করে আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।

Comments