স্বাধীনতা যা দিয়েছে, বিজয় না হলে কী হতো
আয়ারল্যান্ড যখন ইংল্যান্ডের অধীন ছিল তখন আইরিশ জনগণ সম্পর্কে লর্ড মেকওলে একটি মন্তব্য করেছিলেন। আজকের আইরিশদের সঙ্গে যার তুলনা করলে যে কেউ বিস্মিত হবেন। আইরিশদের নিয়ে তার বক্তব্যের সারমর্ম দাঁড়ায় এমন—পৃথিবীজুড়ে বহু বিখ্যাত আইরিশ আছেন, কিন্তু আয়ারল্যান্ডে কোনো বিখ্যাত আইরিশ নেই।
১.
পরাধীন একটি দেশে কী ঘটে—যা তার সন্তানদের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়? তার আভাস পাওয়া যায় আইরিশ জনগণকে নিয়ে মেকওলের এই উদ্ধৃতিতেই।
মেকওলে বলেন, 'অন্যদিকে আদিবাসী চাষীকূল ছিল প্রায় বর্বর দশায়। পেটে খিদের জ্বালা অনুভব না করা পর্যন্ত তারা কাজ করত না। সুখী দেশগুলোর গবাদিপশুর চেয়ে খারাপ বন্দোবস্তেও তারা খুশি থাকত। ইতোমধ্যেই এমন আলু সাধারণ মানুষের খাদ্যে পরিণত হয়েছে যা দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করা যায়। এটি কোনো নৈপুণ্য, পরিশ্রম কিংবা পুঁজি ছাড়াই আবাদ করা সম্ভব। এভাবে পেট ভরানো মানুষদের কাছ থেকে অধ্যবসায় আর ভবিষ্যৎ ভাবনা আশা করা যায় না। এমনকি ডাবলিনের কয়েক মাইলের মধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ও সবুজতম ভূমিতে পর্যটকেরা সেই অবর্ণনীয় কুঁড়েগুলো পাশ কাটিয়ে যেতেন, যেগুলোর ভেতর থেকে নোংরা ও অর্ধনগ্ন বর্বররা বুনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।'
এই মর্মান্তিক বর্ণনা ছিল আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ দখলদারিত্বেরই পরিণতি। পরাধীনতা কৃষকের কাছ থেকে কেড়ে নেয় জমি, নাগরিকের কাছ থেকে কেড়ে নেয় নিজের ও দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার।
এর ভয়াবহ একটি ফল হলো জ্ঞানগত সন্ত্রাস। যারা একটি জাতির সর্বনাশ ঘটায়, তারাই আবার সেই জাতিকে বর্বর, অলস, অদক্ষ, পেটভরা পশুপ্রায় বলে চিহ্নিত করে। এতে জাতি শুধু হীনমন্যতায় বন্দি হয় না, ভবিষ্যৎ নিয়েও আস্থা হারায়। ধীরে ধীরে নিজেদের অক্ষমতার ওপরই তাদের গভীর বিশ্বাস জন্ম নেয়।
২.
জাতীয় মুক্তির স্পর্শ সমাজকে কত গভীরভাবে বদলে দিতে পারে, তার উদাহরণ পাওয়া যায় দুই বাঙালির চীন ভ্রমণকাহিনিতে—মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান।
ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি, রাশিয়াসহ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর আগ্রাসন, ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এবং জাপানি দখলদারিত্ব—সব মিলিয়ে চীন দীর্ঘ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। তাই ১৮৪০ থেকে ১৯৪৫ সময়কালকে তারা চিহ্নিত করেছে 'অবমাননার শতাব্দী' হিসেবে। যেন গোটা বিশ্ব মেতে উঠেছিল চীনকে লাঞ্ছিত করতে।
এই অবমাননার শতাব্দী পেরিয়ে স্বাধীনতার স্পর্শে চীনের জেগে ওঠার বর্ণনায় মওলানা ভাসানী বারবার বলেছেন মানুষের প্রাণবন্ততার কথা। তিনি লিখেছেন, চীনের কৃষকেরা হাসতে জানে, আর বাংলার কৃষকেরা হাসতে ভুলে গেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদের এই পার্থক্য তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।
'মাও সে তুং-এর দেশে' গ্রন্থে ভাসানী লেখেন, 'পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর নির্মিত রাস্তা আর ব্রিজগুলো কতবার যে ভেঙেছে! বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ ভেঙে কত হাজার হাজার একর ফসল নষ্ট হয়েছে, কত লক্ষ মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা বেড়েছে! চীনে থাকার সময় আমার মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে—এদের রাস্তা, ব্রিজ, বাঁধ একবারও ভাঙে না কেন? আর আমাদের দেশে এত ঘন ঘন ভাঙনের কারণ কী? দায়ী কি আমাদের অদৃষ্ট, না দুর্নীতিতন্ত্র?'
১৯৪৯ সালে চীন সফরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-তে লিখেছেন, '"আফিং" খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। এখন আর কেউ আফিং খায় না, ঝিমিয়েও পড়ে না। মনে হলো—নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা নেই। তারা আজ স্বাধীন, দেশের সবকিছু জনগণের। ভাবলাম, মাত্র তিন বছরে এত বড় পরিবর্তন এরা কীভাবে করল!'
ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতার পর কালোবাজারি ও ফাটকাবাজির স্বর্গে পরিণত হয়েছিল। কারণ, নতুন ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া স্থানীয় পুঁজিপতিরা জনগণকে লুণ্ঠনের মাধ্যমেই প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয় করেছিল। চীনের ব্যতিক্রম তাই শেখ মুজিবের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জানান, 'কালোবাজার বন্ধ। জনগণ কাজ পাচ্ছে, চুরি-ডাকাতি বন্ধ। কঠোর হাতে নতুন সরকার এসব দমন করেছে... চীনের মানুষদের চোখে-মুখে নতুন আশা। তারা গর্বিত যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক।'
৩.
মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব—দুজনেই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী। পাকিস্তানের শুরুতে জনগণের মধ্যে যে মুক্তির স্পৃহা ছিল, তার বর্ণনা আছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-তে—'জনগণ ও সরকারি কর্মচারীরা দিনরাত পরিশ্রম করত। টিকিট না পেলেও মানুষ টাকা জমা দিয়ে ট্রেনে উঠত। ম্যাজিকের মতো দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু ভাটা পড়ল—শুধু সরকারের নীতির কারণে।'
স্বেচ্ছাসেবকেরাই যখন সব করত, তখন আমলাতন্ত্র ও মুসলিম লীগ নেতাদের লুণ্ঠনের সুযোগ কমে যাচ্ছিল। তাই খাজা নাজিমুদ্দিন ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, 'এই সুপ্রতিষ্ঠিত সংগঠনকে দেশের উন্নয়নে ব্যবহার না করে সরকারই ক্ষতি করেছে।'
চীন ঠিক উল্টোটা করেছে। মওলানা ভাসানী লক্ষ্য করেন—'আমরা ভাবি রাষ্ট্র চালাতে আমলাতন্ত্র অপরিহার্য। কিন্তু চীন বিপ্লবের অন্যতম সাফল্য হলো আমলাতন্ত্রের কবল থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে মুক্ত করা।'
৪.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর এই শিক্ষাগুলো আমরা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মুক্তিবাহিনী ভেঙে দেওয়া হলো। জাতি গঠনের কাজে তাদের শ্রম ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলো না।
সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান বহুবার বলেছেন, 'মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক বছর বিনা বেতনে কাজ করতেও রাজি ছিলেন। তারা শিক্ষকতা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সড়ক-সেতু মেরামত, কৃষি সহায়তা ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায় পুরোনো আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রই পুনর্বহাল হয়।'
এর ফলেই সমাজে অরাজকতা বাড়ে, শুরু হয় সশস্ত্র লুণ্ঠন, এরপর দুর্ভিক্ষ এবং একদলীয় শাসন।
৫.
পরাধীন আইরিশদের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে মেকওলের মন্তব্যের মতো বদনাম চীনাদেরও ছিল। কিন্তু মওলানা চীনে দেখেন, 'রেলস্টেশন থেকে রেলগাড়ি—সবই ঝকঝকে পরিষ্কার। শুধু স্টেশন নয়, চীনের সর্বত্রই এই পরিচ্ছন্নতা।'
পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে তিনি লেখেন, 'লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সামাজিক জঞ্জাল দূর না করলে অন্য জঞ্জালও দূর হয় না।'
স্বাধীনতা সত্যিই এক ধরনের আগুন—যা জাতিকে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেয়, আবার নিজের জমিন পরিষ্কার রাখার সচেতনতাও তৈরি করে। তবে একটি শর্তেই—মানুষের ওপর চেপে বসা ঔপনিবেশিক কাঠামোর উৎপাটন।


Comments