শোষণের অন্ধকার থেকে সম্ভাবনার ‘নীল’ আলো

অনাবাদি জমিতে নীলচাষ। ছবি: এস দিলীপ রায়

এক সময় ইউরোপের চাহিদা মেটাতে রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের জোরপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করত ব্রিটিশরা। ইংরেজ নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন এই অঞ্চলের চাষিরা। ইতিহাসে তা 'নীলবিদ্রোহ' নামে পরিচিত। এখনও রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ সেই শোষণ-অত্যাচারের সাক্ষ্য বহন করছে।

তবে সময় বদলেছে। এখন আর শোষণের অন্ধকার নয়, বরং নীল চাষে সম্ভাবনার আলো দেখছেন রংপুর ও নীলফামারীর সহস্রাধিক কৃষক। বাড়তি আয়ের আশায় স্বেচ্ছায় নীলচাষ করছেন তারা। স্থানীয়ভাবে নীলগাছকে বলা হয় 'মালখড়ি'। রাস্তার দুধারে, এক ফসলি জমি কিংবা পরিত্যক্ত জমিতেই এখন প্রধানত নীলচাষ হচ্ছে। এতে কৃষকের আয় যেমন বাড়ছে, তেমনি অনাবাদি জমিও কাজে লাগছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রংপুর সদর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া এবং নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বহু গ্রামে প্রতিবছর আড়াই থেকে তিন হাজার বিঘা জমিতে নীলগাছ চাষ হচ্ছে। এপ্রিল মাসে বীজ বোনার তিন মাস পর থেকেই গাছ থেকে পাতা কাটা শুরু হয়, যা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। প্রতি বিঘা জমি থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার কেজি সবুজ পাতা এবং ৫০০ থেকে ৫৫০ কেজি নীলকাঠি (খড়ি) পাওয়া যায়। কৃষকেরা পাতাগুলো বিক্রি করেন, আর নীলকাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। অনেকে নীলকাঠি বিক্রিও করছেন। 

রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের কৃষক সুরেন্দ্র নাথ রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্রিটিশ আমলে নীলচাষ নিয়ে অনেক রক্ত ঝরেছিল। কিন্তু এখন আর কোনো জবরদস্তি নেই। আমি প্রতিবছর তিন-চার বিঘা জমিতে নীল রোপণ করি। এরপর সবুজপাতা বিক্রি করি, নীলকাঠি জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগে।'

'জমি খালি না রেখে পরে আবার শীতকালীন সবজি আর আলু লাগাই। নীলচাষ খুবই সহজ। জমিতে শুধু বীজ বপন করতে হয়। কোনো প্রকার যত্ন ছাড়াই নীলগাছ বেড়ে ওঠে,' তিনি বলেন। 

নাজিরেরহাট এলাকার কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, 'নীলচাষে খরচ কম, শুধু বীজ বপন আর শ্রমিকের খরচ লাগে। গরু-ছাগল নীলগাছ খায় না। রাস্তার ধারে আর এক বিঘা অনাবাদি জমিতে নীলচাষ করছি। নীলচাষে তেমন খরচ নেই। তবে পাতা কাটার সময় শ্রমিক খরচ লাগে। পাতা বিক্রির অর্ধেক টাকা শ্রমিক খরচে চলে যায়।  প্রতিকেজি নীলকাঠি ১০ থেকে ১২ টাকা দরে বিক্রি করি।'

তারাগঞ্জের কুর্শা গ্রামের কৃষক সহিদার রহমান বলেন, 'মার্চের শেষ ও এপ্রিল মাসের শুরুতে বীজ বোনার পর ৯০ দিনে নীলগাছের পাতা কাটার উপযোগী হয়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনবার পাতা কাটা যায়। কিছু গাছ রেখে অক্টোবর মাসে বীজ সংগ্রহ করি। বিশেষ যত্নের দরকার হয় না, একেবারেই সহজ চাষ।'

২০০৫ সাল থেকে রংপুরে নীলচাষের নতুন ধারা শুরু হয়। স্থানীয় উদ্যোক্তা নিখিল চন্দ্র রায় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের হরকলি ঠাকুরপাড়ায় নীল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করেন। কৃষকেরা তার কাছে প্রতি কেজি সবুজ পাতা চার থেকে পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করছেন।

পাতা কাটার পর সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টার মধ্যে পানিতে জাগ দিতে হয়। বড় চৌবাচ্চায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পাতা জাগ দেওয়ার পর একটি নির্যাস পাওয়া যায়। পরে আরেক চৌবাচ্চায় পাতার সবুজ রঙের গাদকে আড়াই থেকে চার ঘণ্টা অক্সিডাইজেশন করতে হয়। এ সময় সবুজ রঙের গাদ বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়ায় নীল রঙের গাদে পরিণত হয়। সেটি সাদা মার্কিন কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হয়।

এরপর নীল রোদে শুকানো হয় অথবা জ্বাল দেওয়া হয়। এখান থেকে কেক ও গুঁড়া আকারে নীল পাওয়া যায়। নীল তৈরিতে বিভিন্ন ধাপে সময়ের হেরফের হলে নীলের গুণগত মানের তারতম্য ঘটে। এক সময় নীল রংয়ের একমাত্র উৎসই ছিল এ নীলগাছ।

ইন্ডিগো ফিল্ডস লিমিটেডের (আইএফএল) পরিচালক নিখিল রায় বলেন, '২৫০-৩০০ কেজি সবুজ পাতা থেকে এক কেজি নীল পাওয়া যায়। উৎপাদিত নীল গার্মেন্টস-ফ্যাক্টরিতে রং হিসেবে সরবরাহ করছি। পাশাপাশি বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করছি, আর সেই বর্জ্য দিয়েই বানাচ্ছি উৎকৃষ্ট জৈব সার। এতে স্থানীয় অনেকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে।' 

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্রিটিশ শাসনামলে নীলকরদের অত্যাচার চাষিদের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। এখন কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিখিল চন্দ্র রায়ের মতো উদ্যোক্তার কারণে কৃষকরা নীলচাষে লাভবান হচ্ছেন। নীলগাছ জমির নাইট্রোজেনের মাত্রা ঠিক রেখে উর্বরতা বাড়ায় এবং পরিবেশবান্ধব সার হিসেবে কাজ করে।'

তিনি বলেন, 'বর্তমানে অনাবাদি জমি কাজে লাগানো, পরিবেশবান্ধব সার উৎপাদন, গার্মেন্টস খাতে চাহিদা এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান— সব মিলিয়ে রংপুর অঞ্চলে নীলচাষ নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। একসময়ের শোষণ-অত্যাচারের প্রতীক এই নীল আজ হয়ে উঠছে কৃষকের বাড়তি আয়ের নিশ্চয়তা।'
 

Comments

The Daily Star  | English
Taka vs us dollar in Bangladesh

US dollar rises against taka

The American greenback was sold for as high as Tk 122.75 today, up from a high of Tk 122.30 last week

1h ago