নিখোঁজ স্বজনের দেখা মিলল জঙ্গি-প্রশিক্ষণ ভিডিওতে

পার্বত্য চট্টগ্রামে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

আবু জাফর গত ৩ বছর ধরে মালদ্বীপে থাকেন বলে জানত তার পরিবার। এর আগে তিনি থাকতেন সৌদি আরবে। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে মালদ্বীপের কথা বলে বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি।

জাফরের পরিবারের সদস্যদের দাবি, এরপর থেকে আবু জাফরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হতো তাদের। প্রতিবারই মালদ্বীপে থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু গত ২ মাস আগে ফরিদপুরের চর ভদ্রাসনে আবু জাফরের বাড়িতে গিয়ে কয়েকজন র‍্যাব সদস্য তার সম্পর্কে তথ্য নিয়ে যায়।

সর্বশেষ গতকাল সোমবার আবু জাফরের দুলাভাই মো. শাহজাহান পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে জঙ্গিদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের একটি ভিডিওতে আবু জাফরকে শনাক্ত করেন। ওই ভিডিওতে একটি রান্নার দৃশ্যে গলায় গামছা পরে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে।

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া জঙ্গিদের এই ভিডিওটি দেখে অনেক পরিবার তাদের নিখোঁজ স্বজনদের শনাক্ত করেছেন। এমন ১০টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার, যাদের বেশিরভাগই ভিডিও দেখে তাদের স্বজনদের শনাক্ত করেছেন।

এদের মধ্যে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা রায়হানের কথা জানান তার বাবা আবুল কালাম। গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও দেখে রায়হানকে শনাক্ত করা হয়। ভিডিওতে রান্নার ২টি দৃশ্যে তাকে দেখা যায়। আবুল কালাম জানান, রায়হানকে শনাক্ত করার পর শুক্রবার তারা র‍্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

রায়হান কীভাবে জঙ্গিদের দলে ভিড়ল সে ব্যাপারে জানতে চাইলে আবুল কালাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শ্রমিক ভিসায় ২০১৮ সালে রায়হান দুবাই যান। ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর এক নারী রায়হানের মামাকে ফোন করে বলেন, রায়হান দেশে ফিরেছে। ২ দিন আগে দেশে ফিরে সে ঢাকার বাড্ডায় এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছে। ওই বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে গেলে জানানো হয়, রায়হান কুমিল্লায় আরেক বন্ধুর বাড়িতে গেছে। সেখানে গিয়েও রায়হানের খোঁজ না পাওয়ায় বিষয়টি তখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানানো হয়। এর পর আর রায়হানের কোনো হদিস মিলছিল না।

২ মাস আগে কয়েকজন ব্যক্তি র‍্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে বাড়ি থেকে রায়হানের সম্পর্কে তথ্য নিয়ে যায়। এরপর ভিডিও দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়। রায়হানকে জীবিত উদ্ধার করে আইন অনুযায়ী পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান তার বাবা।

রায়হানের বাবা মনে করছেন, বিদেশে থাকা অবস্থাতেই রায়হানকে জঙ্গি দলে ভেড়ানো হয়েছে।

ঢাকার শুক্রাবাদের নিউ মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী মাহমুদ ডাকুয়া পড়ালেখার পাশাপাশি নীলক্ষেতে বইয়ের ব্যবসা করতেন। পুরান ঢাকার ললিত মোহন দাস লেনে ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে তিনি বসবাস করতেন। ২০২১ সালের ১৮ মার্চ বিকেলে কেনাকাটার কথা বলে নীলক্ষেতের দোকান থেকে বের হন তিনি। এরপর তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরদিনই নিউ মার্কেট থানায় সাধারণ ডায়রি করেন তার স্বজনরা। পরে তার সন্ধান চেয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগানো হয়। কিন্তু আর খোঁজ মেলেনি মাহমুদের।

গত বুধবার মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিওতে মাহমুদকে শনাক্ত করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ধারণ করা জঙ্গি প্রশিক্ষণের ওই ভিডিওতে অন্তত ৩টি জায়গায় তাকে দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ে তারা গত রোববার কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে যোগাযোগ করেন।

মাহমুদের ভাই রাসেল ডাকুয়া ডেইলি স্টারকে জানান, ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর তিনি মাহমুদকে বরিশালের বাকেরগঞ্জের বাড়ি থেকে ঢাকায় এনে কলেজে ভর্তি করান। ভাইয়ের বইয়ের ব্যবসাতে সাহায্য করত মাহমুদ।

রাসেলের ভাষ্য, ছোট ভাইকেও বইয়ের ব্যবসায় নামিয়েছিলেন তিনি। ১০ লাখ টাকা জামানত দিয়ে মিরপুরে একটি বইয়ের দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন। দোকান সাজানোর কাজও শেষ পর্যায়ে ছিল। এর মধ্যেই নিখোঁজ হন মাহমুদ।

ভাইয়ের পরিবর্তন সম্পর্কে রাসেলের বক্তব্য, নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগে মাহমুদের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। এক লোক তার কাছে নিয়মিত যাওয়া-আসা করত। রাসেলের ধারণা, ওই ব্যক্তির মাধ্যমেই তার ভাই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।

রাসেল বলেন, 'আমার ভাই মাহমুদ ভুল পথে আছে। তাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে পরিবারের কাছে সোপর্দ করা হোক। প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবুও সে ওই পথ থেকে ফিরে আসুক।'

এ বিষয়ে র‍্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে তারা নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্য। তারা পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং নিচ্ছে। সেখানে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হুজিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৫৫ জন ছিলেন বলে র‍্যাব জানতে পেরেছে। তারা ৩ ধাপে পাহাড়ে ট্রেনিংয়ে গেছে। ট্রেনিংয়ের জন্য তারা প্রতি মাসে ৩-৫ লাখ টাকা কেএনএফকে দেয়। ব্যক্তিগত চাঁদাসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা চাঁদা পেয়েছে।'

প্রশিক্ষণের অস্ত্রের ব্যাপারে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, 'দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি তারা (জঙ্গিরা) পার্শ্ববর্তী একটি দেশ থেকে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করেছে।'

ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপটির বিষয়ে মশিউর রহমানের ভাষ্য, 'গত ২৩ জানুয়ারি কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার শুরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান রনবীর এবং তার সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারকে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আটক করে র‍্যাব। রনবীরের কাছে পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের ভিডিও ক্লিপটি পাওয়া যায়।'

Comments

The Daily Star  | English

'Some of your men are working in favour of a particular party'

Jamaat tells chief adviser; presses for constitutional recognition of July Charter

50m ago