সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা

জেলেদের দুশ্চিন্তা-দুর্বিপাকের ৬৫ দিনের শুরু

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নে জেলেরা জাল পরিষ্কার করে শুকিয়ে রাখছেন। ছবি: মনির উদ্দিন অনিক

পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটার খালগোড়া এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফ (৪০) সেই ছেলেবেলা থেকেই সাগরে গিয়ে মাছ ধরেন। তার ৬ সদস্যের পরিবারে দৈনিক অন্তত ৩ কেজি চালের দরকার হয়। সে হিসেবে মাসে তার চাল লাগে ৯০ কেজির মতো।

কেবল ৩ বেলা কোনোভাবে খাওয়ার জন্য চালের পাশাপাশি ডাল, শাকসবজি ও পেঁয়াজ-তেলসহ অন্যান্য দরকারি জিনিসেরও দরকার হয়। সীমিত আয় দিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে স্বাভাবিক সময়েও এগুলোও জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যান হানিফ। তাই বাধ্য হয়ে ধার-দেনা করে কোনোভাবে সংসার চালাতে হয় তাকে।

মাছ ধরা ও এ সংক্রান্ত কাজ ছাড়া অন্যকিছু শেখা হয়নি হানিফের। তাই তার কাছে কাজ বন্ধ মানে আয়ও বন্ধ।

বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও ইলিশসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের সুষ্ঠু প্রজনন নিশ্চিত করতে বঙ্গোপসাগর ও নদী মোহনায় মৎস্য আহরনে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে আজ শনিবার থেকে। এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত। দেশের উপকূলীয় এলাকার ১৪ জেলা, ৬৫ উপজেলা ও চট্টগ্রাম নগর এই নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত।

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় জাল গুছিয়ে রাখছেন এক জেলে। ছবি: স্টার

মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, এসব এলাকার সাড়ে ৩ লাখের বেশি নিবন্ধিত জেলে ছাড়াও ৬৮ হাজার মেকানাইজড বোট ও ২৬০টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বোটের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে।

কুয়াকাটার জেলে আবু হানিফের কাছে এই ৬৫ দিনের প্রতিদিনই দুশ্চিন্তার, দুর্বিপাকের। কারণ, তার কাছে মাছ ধরা বন্ধ মানে আয়ও বন্ধ।

হানিফ বলছেন, নিষেধাজ্ঞার পুরো সময়টাতে তাদের খাদ্যসহায়তা হিসেবে কেবল ৮৬ কেজি চাল দেওয়া হয়। তাও সবাই এটা ঠিকঠাক পান না। এই চাল দিয়ে কোনোভাবে ১ মাসের ভাতের চাহিদা মেটে। অন্য চাহিদাগুলো মেটাতে তাকে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। কারণ তার আশপাশে যে জেলে পরিবারগুলো থাকে, তাদেরও ধার দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি থাকে না।

হানিফসহ পটুয়াখালী ও বরিশাল অঞ্চলের অন্য জেলেদের ভাষ্য, সাগরে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তাই তাদের স্বাভাবিক আয় এমনিতেই অনেক কমে গেছে। এর ওপর যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির খড়গ। এমন পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞার ৬৫ দিন তারা কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন তারা।

এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞার দিনগুলো পরিবার নিয়ে আরেকটু ভালোভাবে পার করতে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ আরও খানিকটা বাড়ানোর আকুতি জানিয়েছেন জেলেরা। আর চালের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবিও এসেছে তাদের কাছ থেকে।

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার কারণে কর্মচাঞ্চল্য নেই পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর মৎস বন্দরে। ছবি: স্টার

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ২ মাস

মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এর আওতায় থাকলেও ২০১৯ সালে সব ধরনের নৌযানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, পটুয়াখালী জেলায় সমুদ্রগামী তালিকাভুক্ত জেলেদের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৩৪৮ জন।

কুয়াকাটা এলাকার ইলিশ শিকারি আব্দুর রহমান জানান, 'বছরের বেশিরভাগ সময় নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। ধার-কর্জ করে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে হয়। এ কারণে ঋণের বোঝাও পিছু ছাড়ে না। ভিজিএফ কর্মসুচির আওতায় যে পরিমাণ চাল দেওয়া হয় তা খুবই কম।'

চর গঙ্গামাতি এলাকার জেলে আব্দুল হালিম জানান, 'শুধু চাল দিয়ে তো হয় না। আমাদের আর্থিক সহযোগিতাও দরকার।'

কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর মৎস্য অবতরণ এলাকার আড়তদার ও ট্রলার মালিক মো. ফজলু গাজির ভাষ্য- নিষেধাজ্ঞা, মাছের আকাল, সাগরে ডাকাতের উপদ্রবসহ বিভিন্ন কারণে জেলেরা এখন আর এ পেশায় থাকতে চান না। গত ৫ বছরে এখানকার প্রায় ৪ হাজার জেলে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। এভাবে চলতে থাকলে দক্ষ জেলের সংকটে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বিঘ্নিত হবে।'

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
কুয়াকাটায় সাগরের তীরবর্তী এলাকায় মাছ ধরা ছোট নৌকাগুলো বালুচরে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। ছবি: স্টার

কুয়াকাটা সংলগ্ন খালগোড়া এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২ শতাধিক ঘরে বসবাসকারীদের বেশিরভাগ পুরুষ সদস্য সাগরে মাছ ধরেন। এদের অধিকাংশই অন্যের ট্রলারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

এই এলাকার জেলে জব্বার হাওলাদার বলেন, 'আমার ৩ ছেলে-মেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করে। সাগরে মাছ ধরে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাই। কোনো সঞ্চয় নেই। নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে যে পরিমাণ চাল দেওয়া হয় তাতে ১ মাসও চলে না। ৬৫ দিন কীভাবে চলবে? অন্যান্য খরচ তো আছেই।'

পটুয়াখালীর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান, ৬৫ দিনের এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্রলার মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উপকূলীয় এলাকার গুরুত্বপুর্ণ জায়গাগুলোতে মাইকিং করার পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া জেলেসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হচ্ছে। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার বরফকলগুলোও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে বিশেষ অভিযান পরিচালনাসহ বিভিন্ন কাজে কোস্টগার্ড নৌ পুলিশ ও সাধারন পুলিশও কাজ করছে।

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার কারণে ভোলার দৌলতখান উপজেলার স্লুইচগেট এলাকায় নোঙর করা ট্রলার। ছবি: মনির উদ্দিন অনিক

আর্থিক সহায়তার দাবি বরিশাল-ভোলার জেলেদেরও

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বরিশাল বিভাগে ৩ লাখ ৬ হাজার লাখ নিবন্ধিত জেলের মধ্যে সমুদ্রগামী জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার। আর মেকানাইজড বোট আছে ১০ হাজার ৫১৫টি।

গতকাল শুক্রবার ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপোতা ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরের মাছঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অন্তত দেড়শ সমুদ্রগামী ট্রলার মেরামতের অপেক্ষায় আছে।

এখানকার সমুদ্রগামী জেলে হান্নান মিয়া জানান ঘুর্ণিঝড় মোখার পর তারা আর সমুদ্রে মাছ ধরতে নামতে পারেননি। এখন বোটগুলি মেরামতের কাজ করছেন।

এখানকার আরেক জেলে আমজাদ মাঝির বলেন, 'নিষেধাজ্ঞার সময়টা কোনোভাবে পার করার জন্য অন্তত দেড়শ কেজি চাল ও নগদ অর্থ সহায়তা দরকার।'

বরিশাল ক্ষুদ্র মৎসজীবী উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইসরাইল পণ্ডিতও একই দাবি জানান।

Comments

The Daily Star  | English

Experts from four countries invited to probe into Dhaka airport fire: home adviser

Says fire that spread fast due to chemicals, garment materials was contained in time

14m ago