চাঁদাবাজি

‘নৌকায় উঠলে পুলিশে দাবড়ায়, জাল বাওয়া বাদ দিয়্যা বইসা রইছি’

‘নৌকায় উঠলে পুলিশে দাবড়ায়, জাল বাওয়া বাদ দিয়্যা বইসা রইছি’
মানিকগঞ্জের পদ্মাপাড়ের জেলেদের অভিযোগ, নৌ পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে তারা মাছ ধরা ছেড়ে দিয়েছেন | ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

মানিকগঞ্জের শিবালয়ের আরুয়া ইউনিয়নের নয়াকান্দি গ্রামের অন্তত ৬০টি পরিবারের বর্তমানে জীবিকার প্রধান উৎস মাছ শিকার। তবে এই পেশা ছেড়ে সম্প্রতি তাদের অধিকাংশই বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছেন।

গ্রামঘেঁষা পদ্মাপাড়ে বেঁধে রেখেছেন সারি সারি নৌকা। ইতোমধ্যে অনেকে বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের নৌকা ও জাল। জেলেদের অভিযোগ, নৌ পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে তারা পেশা বদলানোর কথা ভাবছেন।

তারা জানান, নৌ পুলিশকে চাঁদা না দিলে মাছ ধরা যায় না। নৌকা-জাল নিয়ে যায়, মামলা দেয়, সাজা হয়।

‘নৌকায় উঠলে পুলিশে দাবড়ায়, জাল বাওয়া বাদ দিয়্যা বইসা রইছি’
নৌ পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে নৌকা ডাঙায় তুলে রেখেছেন জেলেরা | ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

জেলেদের বেশিরভাগই আগে কৃষি কাজ করতেন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ১৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে শিবালয় উপজেলায় স্পেকট্রা সোলার পার্ক লিমিটেড (এসএসপিএল) প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভাঙনে অনেকে হারিয়েছেন চাষের জমি। কারও কারও এখনো কিছুটা কৃষি জমি আছে, তবে পরিমাণ কম হওয়ায় চাষাবাদ থেকে হওয়া আয়ে সংসার চলে না।

নয়াকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেমের বয়স এখন ৬০ বছর। তার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের এই সংবাদদাতার বৃহস্পতিবার কথা হয়। তিনি বলেন, 'নৌকায় উঠলে পুলিশে দাবড়ায়। হে জন্য জাল বাওয়া বাদ দিয়্যা বইসা রইছি।'

কাশেম বলেন, 'জাল বাইবার দিবো না, জাল নিয়া পুড়াইয়া ফালায়। পুলিশরে দেওয়ার মতো ট্যাকা আমার নাই। বোট নিয়া আসে, কয় মাছ মারা নিষেধ—তোমরা মাছ মারো ক্যা? গতবার বাইলা মাছ মারায় একজনরে মামলায় দিছিলো, পয়সা-পাতি হয়তো দেয় নাই। জেল খাইটা আইলো।'

একই গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'নদীতে মাছ মারব্যার আইলে পুলিশে জাল নিয়া যায়, জাল আনবার গেলে কয় ট্যাকা দেও। ট্যাকা দিলে ছাইড়া দিমু, তাছাড়া ছারুম না।

'আমি নৌকা বিক্রি কইরা ফালাইছি ওই ভয়তেই। মাছ যেহেতু মারবার পারুম না নদীতে, তাইলে নৌকা আর জাল রাইহা তো লাভ নাই! পরে আমি নৌকা-জাল বিক্রি কইরা ফালাইছি,' বলেন তিনি।

দেলোয়ারের এখনো সামান্য জমি আছে। সেই জমিতে আবাদ করার পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

নদীতে জেলের সংখ্যা কম থাকলে চাঁদা না নিয়ে পুলিশ জাল-নৌকা জব্দ করে জানিয়ে আব্দুল মালেক বলেন, 'পুলিশ আইসা সাইর‌্যা বোটে থ্যা (থেকে) ট্যাকা উঠায়। যেদিন বোট একটু কম আসে, সেইদিন ওরা আমাগো কাছ থ্যা জাল নিয়া যায়। আবার ৫০০ থেকে এক হাজার ট্যাকা দিলে ছাইড়া দেয়।'

ইলিশের প্রজনন মৌসুম ছাড়া মাছ ধরা অবৈধ না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'জাটকা মারতাছি না তো! আমরা মারি বেলে মাছ। এই বেলে মাছ মারতে গেলেও আমাদের সমস্যা।'

চাঁদা নেওয়ার জন্য নৌ পুলিশ সারা দিন তক্কে তক্কে থাকে বলে অভিযোগ করেন মো. নেওয়াজ।

আরেক জেলের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, 'তিন দিন আগে রজ্জবের জাল নিয়ে গেছিলো। জাল আনার জন্য চার হাজার ট্যাকা চাইছিলো, পরে দুই হাজার ট্যাকা দিয়া রজ্জব জাল আনছে।'

মাছ শিকার বন্ধ হওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েছে জেলে পরিবারগুলো। আব্দুল কাদের প্রামানিকের স্ত্রী মোছাম্মত শিরিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীতে জাল ফেললেই পুলিশ আইসা দাবড় দেয়। জাল উঠাইয়া নিয়া যায়, নাইলে ট্যাকা দাবি করে। দুই-পাঁচ হাজার ট্যাকা দিলে জালও দিমু, ছাইড়াও দিমু।

'একটা জাল বানতেও কষ্ট হয়। আবার অনেক ট্যাকা খরচও হয়। কৃষি কাজ করার মতো চকে জমি নাই আমাগো। এই নদীর কামাই আমাগো খাওয়া লাগে। যদি জাল নিয়া যায়, তাইলে আমাগো কষ্ট হয় না,' প্রশ্ন রাখেন শিরিন।

ষাটোর্ধ এই নারী আরও বলেন, 'আমাগো কাছে তো সব সময় ট্যাকা থাকে না। ৫০০, ৪০০, ৩০০ ট্যাকার মাছ মারে। জমা অইবো কত? সংসারের খরচ জানেনই তো! সব কিছুর কত দাম।'

পদ্মার এই অংশে জাল ফেললে লাঠি, নোয়াগারা, বেলে, খসল্লা, চাপিলা, টাটকিনি, আইড়, বাঘাইড়, নওলা, রুই মাছ ওঠে। বড় মাছ সাধারণত হরিরামপুর উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকায় ধরা পড়ে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে একই অভিযোগ করেন গ্রামের রাজু মুন্সী, আব্দুল হাকিম, কামরুল ইসলাম, মাসুদা বেগম, রেজাউল করিমসহ আরও অনেকে। তারা নৌ পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজবাড়ী নৌ পুলিশের অধীনে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজবাড়ির দৌলতদিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা পাটুরিয়া এলাকায় এসে এসব করছেন বলে শুনেছি। এতে আমাদের বদনাম হচ্ছে। এ কারণে আমি তাদের এদিকে আসতে নিষেধ করেছি। আমার লোকজনকেও বলেছি এসব করা যাবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

One killed as bearing pad of metro rail falls at Farmgate, train operations halted

As a safety measure, metro rail services remain suspended from 12:30pm, Dhaka Mass Transit Company Limited official says

33m ago