টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব ভারতের, তাঁতী ও নাগরিক সমাজের ক্ষোভ

ছবি: স্টার

টাঙ্গাইলে উৎপাদিত তাঁত শাড়ির বিশ্বে আলাদা খ্যাতি ও কদর রয়েছে। বাহারী রঙ ও বৈচিত্রপূর্ণ ডিজাইনের কারণে বিভিন্ন উৎসব পার্বনে বাঙ্গালী নারীদের পছন্দের প্রথম তালিকায় থাকে টাঙ্গাইলের শাড়ি।

প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষ।

সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব আদায় করে নেয়। এর প্রতিবাদে ক্ষোভ জানিয়েছেন জেলার তাঁতী ও নাগরিক সমাজ।

টাঙ্গাইলের তাঁতীদের দাবি, যদিও স্থানীয় বসাকদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমিয়েছেন এবং সেখানেও তারা শাড়ি তৈরি করে টাঙ্গাইল শাড়ি নামে বিক্রি করছেন, তাতে টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হয়ে যেতে পারে না। টাঙ্গাইল শাড়ির আদি পরিচয় হচ্ছে টাঙ্গাইলে তৈরি শাড়ি, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি।

টাঙ্গাইলের শাড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, টাঙ্গাইলে উৎপাদিত শাড়ির প্রায় ২০ শতাংশ ভারতে রপ্তানি হয়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ ও বিভিন্ন স্থান থেকে টাঙ্গাইলে এসে এই শাড়ি নিয়ে যান ভারতের অনেক মানুষ, সেই টাঙ্গাইল শাড়ি কিভাবে ভারতীয় পণ্য হয়ে গেল সেটি তাদের বোধগম্য নয়।

টাঙ্গাইলের পাথরাইল তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, 'টাঙ্গাইল শাড়ির গোড়াপত্তন বলতে গেলে টাঙ্গাইলকেই বোঝায়। টাঙ্গাইলে যে শাড়ি উৎপাদন হতো তাঁতে সেটাকেই বলা হয় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তথা টাঙ্গাইল শাড়ি। সেখানে (ভারতে) টাঙ্গাইল বলতে কোনো জায়গাই নাই, কী কারণে অন্য জায়গা থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির ট্যাগ নেবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের টাঙ্গাইলে যে টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদন হয় এটা ভৌগলিক কারণে, আবহমান কারণে, এই শাড়িটা জন্য যে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দরকার, আমাদের এলাকাটা সেই আবহাওয়ার। আমাদের এই শাড়ি উৎপাদনের সাথে যারা জড়িত তারা সবাই বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেমন কিশোরগঞ্জ, ঢাকা, ধামরাই, চৌহাট, বাওখন্ড এই সব এলাকা ঘুরে কোথাও শাড়ি বুননের যে আবহাওয়ার প্রয়োজন সে আবহাওয়া পায়নি। আমাদের টাঙ্গাইলে এসে সেই আবহাওয়াটা পাওয়াতে টাঙ্গাইলেই আমাদের আগের প্রজন্ম এর ভিত্তি স্থাপন করেন এবং এখানেই টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদন হয়।'

রঘুনাথ বলেন, 'টাঙ্গাইলে উৎপাদন হয় বলেই এটা টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। ভিন্ন মানে ভিন্ন দক্ষতার মাধ্যমে এই শাড়ি তৈরি হয়। এই দক্ষতা অন্য জায়গায় ইনভেস্ট করে সেটি তৈরি করতে পারে কিন্তু সেটি টাঙ্গাইল শাড়ি হতে পারে না। সেটি হতে পারে ঢাকাই শাড়ি, রাজশাহীর শাড়ি কিংবা মুর্শিদাবাদের শাড়ি। টাঙ্গাইলে যেটা উৎপাদিত হয় সেটাই টাঙ্গাইলের শাড়ি। অন্য এক জায়গায় গিয়ে শাড়ি উৎপাদন করে সেটাকে টাঙ্গাইল শাড়ি নাম দিয়ে জিআই ট্যাগ নেবে, এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।'

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর, করটিয়া, সন্তোষ, বিন্যাফৈর বেলতা, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলশোধা, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, কুকরাইল, বাসাইল উপজেলার বাথুলী ও সখীপুর উপজেলার তক্তারচালা সহ বিভিন্ন গ্রামের তাঁত পল্লীগুলিতে টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদিত হয়। এই শিল্পের সঙ্গে মালিক-শ্রমিকসহ জড়িতদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।

এদিকে টাঙ্গাইল শহরে নাগরিক সমাজের মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, টাঙ্গাইল যেহেতু বাংলাদেশের একটি জেলা এবং আড়াইশ বছরের বেশি সময় ধরে নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে সারা বিশ্বে সুনাম তৈরি করেছে, এটি কোনোভাবেই ভারতীয় পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতি পেতে পারে না।

অবিলম্বে ভারতের জিআই স্বত্ব বাতিল করে বাংলাদেশের পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের দাবি জানান তারা। এছাড়াও টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি অন্য দেশ কীভাবে পেলো এবং এজন্য দেশে সংশ্লিষ্ট যাদের ব্যর্থতা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হয়।

টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন মুয়ীদ হাসান, নাদিউর রহমান, আহসান খান, মির্জা রিয়ানসহ আরও অনেকে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি, মধুপুরের আনারস, জামুর্কির সন্দেশ এগুলোর জন্য আমরা ইতোমধ্যেই আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এর অনেকগুলো ধাপ আছে। ডকুমেন্টেশন করতে হয়, এটা যে এখানকার অরিজিন সেটির সুদীর্ঘ ৫০ বছরের একটি ধারাবাহিকতা দিতে হয়, অথচ টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি ৫০ বছর তো দুরের কথা ২৫০ বছরের পুরাতন। সেই হিসেবে আমরা আশাবাদী এই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি আমরা পাবো।'

'ভারত যেটা করেছে তারা ডকুমেন্টেশনে উল্লেখ করেছে যে, এই যে বসাক পরিবাররা আছে এখানে পাথরাইলে তাদেরই আদিপুরুষ ওখানে গিয়ে এই তাঁত শাড়ির একটি ভিন্ন প্রকার উদ্ভাবন করেছে, পাড়ের ডিজাইন চেঞ্জ করে। এই ডকুমেন্টেশনটা আমরা দেখেছি। ইতোমধ্যেই আমরা স্টাডি করা শুরু করেছি। গতকালই এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপারর্টি অর্গানাইজেশন যেটা আছে সেখানে কীভাবে আবেদন করা যায় সেটা আমরা চিন্তা করছি। বিভিন্নভাবেই এই আর্বিট্রেশনটাকে এড্রেস করা যায়। একটা হলো যে দেশ ভুলবশতঃ এভাবে জিআই পণ্য স্বীকৃতি নেবে তাদের সাথে দ্বিপাক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে মিনিস্ট্রি টু মিনিস্ট্রি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে এটি করার সুযোগ আছে। আরেকটি হলো যদি দ্বিপাক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি এক বছরের মধ্যে একটি আপিল করার বিধান আছে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপারর্টি অর্গানাইজেশনের এগ্রিমেন্ট অনুসারে সেটিও আমরা সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছি।

'আমরা শুক্রবার বিষয়টি জানতে পেরেছি এবং জেনে পরের দিন শনিবার থেকেই আমাদের কার্যক্রমটা শুরু করেছি। আজ (রোববার) আমি মিনিস্ট্রিতে কথা বলব, পেটেন্ট অধিদপ্তরে কথা বলব, যারা জিআই পণ্য নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে কথা বলবো। যেহেতু একটা ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের রেগুলার প্রসেসের পাশাপাশি কিভাবে দ্রুততম সময়ে কিভাবে এটিকে এড্রেস করা যায় আমরা সেই প্রচষ্টা অব্যাহত রাখব,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

1h ago