জিআই অনুমোদনে তড়িঘড়ি, তথ্য ঘাটতির আশঙ্কা বিশ্লেষকদের

টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির জন্য সুতা কাটছেন এক নারী। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার ফাইল ফটো

শিল্প মন্ত্রণালয় সম্প্রতি মাত্র আট দিনের ব্যবধানে ১০ স্থানীয় পণ্যকে ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) মর্যাদার জন্য প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে।

একটি পণ্যের ভৌগলিক উৎস সম্পর্কে জানা যায় এর জিআই তথ্যের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশে উৎপাদিত পণ্যগুলোর ঐতিহ্য ও খ্যাতি তুলে ধরা হয়। সাধারণত অন্য কোথাও উত্পাদিত একই ধরনের পণ্যের তুলনায় জিআই মর্যাদা পাওয়া পণ্যের দাম বেশি।

মেধাস্বত্ব অধিকারের শাখা হিসেবে বিবেচিত জিআই মর্যাদা পাওয়া পণ্যের বিপণন অধিকার ও আইনি সুরক্ষা সেই নির্দিষ্ট দেশের জন্য সংরক্ষিত থাকে।

বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থা ডব্লিউআইপিও নির্ধারিত বিধিমালার ভিত্তিতে তৈরি ভৌগোলিক নির্দেশক (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) প্রাথমিকভাবে এই স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।

জিআই মর্যাদায় ইলিশ। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

নিয়ম অনুযায়ী, উৎপাদকদের সংগঠন বা উৎপাদকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে এমন সরকারি সংস্থা পণ্যের জিআই মর্যাদার জন্য আবেদন করতে পারে।

এর জন্য আইনি ও ঐতিহাসিক তথ্য, রেফারেন্স, গবেষণা, প্রকাশনা, সাক্ষ্য ও এ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন যা জিআই দাবির পক্ষে প্রমাণ দেয়।

জিআই মর্যাদা চাওয়ার আবেদনে যদি এসব তথ্য থাকে তবে শিল্প মন্ত্রণালয় সেগুলো যাচাই করে জার্নাল হিসেবে প্রকাশ করে।

এসব তথ্য নিয়ে আপত্তি থাকলে তা দুই মাসের মধ্যে জানানো যেতে পারে। সেগুলোর সমাধান হয়ে গেলে, মন্ত্রণালয় জিআই মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করে।

২০১৩ সালে আইনটি প্রণয়নের পর থেকে গত ১০ বছরে ২১ পণ্যকে জিআই মর্যাদা দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়ির পর আট দিনে ১০ পণ্যের জার্নাল প্রকাশ করা হয়।

গত ৩১ জানুয়ারি ভারত 'বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি'কে জিআই মর্যাদা দেয়।

জিআই মর্যাদা পাওয়া নাটোরের কাঁচা গোল্লা। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

গত ৭ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের আবেদনের ভিত্তিতে ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়িকে প্রাথমিক জিআই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি শাড়ির গেজেট প্রকাশ করা হবে।

তবে মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানা গত ৭ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান যে, তারা জার্নালে প্রকাশের আবেদন গ্রহণ করেছেন।

আগামী দুই মাসের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।

তবে সেই ১০ পণ্যের আবেদন ঠিকমতো যাচাই করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা চান, যথাযথভাবে তথ্য যাচাই করতে হবে যাতে কোনো সামঞ্জস্যহীনতা না থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আবেদনপত্র ও সংশ্লিষ্ট তথ্য জার্নালে প্রকাশের উপযুক্ত কিনা তা যাচাই করতে সাধারণত তিন থেকে চার মাস সময় লাগে।'

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাস্বত্ব আইনের পিএইচডি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আতাউল করিম মনে করেন, জিআই মর্যাদার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত সবসময় সক্রিয় ভূমিকা রাখা।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেখা যাচ্ছে, ভারত যখন আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেয়, তখন আমরা সেই পণ্যের জিআই দাবি নিয়ে কাজ শুরু করি। আমাদের উচিত আগে থেকেই কাজ শুরু করা। যেমন, ভারত জিআই পণ্য হিসেবে "উপ্পদা জামদানি" শাড়িকে নিবন্ধিত করার কয়েক বছর পর আমাদের জামদানির জিআই প্রসঙ্গ আলোচনায় আসে। টাঙ্গাইলের শাড়ির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।'

তার মতে, 'বর্তমানে আমাদের কিছু আলোচনা বেশি আবেগ-তাড়িত বা কম বাস্তববাদী।'

ডব্লিউআইপিও'র পরামর্শক মোহাম্মদ আতাউল করিম আরও বলেন, 'আবেদনকারীদের সময় লাগলেও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যথাযথভাবে সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করতে হবে।'

জিআই স্বীকৃতির জন্য ১০টি জার্নাল এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রকাশ করায় সেগুলোর তথ্য যথাযথ আছে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'তথ্যে গড়মিল থাকলে অন্যরা তা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পেয়ে যাবেন। এর ফলে জিআই মর্যাদা বাতিল হতে পারে।'

'বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি'র জিআই মর্যাদা দেওয়ার আগে ভারত এর তথ্য যাচাইয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় চার বছর সময় নিয়েছে।'

মোহাম্মদ আতাউল করিম জানান, ভারত জিআই মর্যাদার আবেদনে বলেছে, 'বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি' বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিদের তৈরি।

তিনি বলেন, 'টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই মর্যাদার জন্য বাংলাদেশের আবেদনে অভিবাসন নিয়ে কিছু বক্তব্য থাকলেও তা যথেষ্ট জোরালো নয়।'

'এ ধরনের অভিবাসন টাঙ্গাইল শাড়ির ওপর ভারতের দাবিকে যৌক্তিক করে কিনা তা বাংলাদেশের খতিয়ে দেখা উচিত' উল্লেখ করে মোহাম্মদ আতাউল করিম বলেন, 'প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র হাতে থাকলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) বিষয়টি নিষ্পত্তিতে সেগুলো বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।'

'প্রতিবেশী দুই দেশের জন্য একই রকম অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য,' যোগ করেন তিনি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট বিভাগের মহাপরিচালক মুনিম হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যথাযথ প্রক্রিয়া ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে জিআই স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ভুল-ত্রুটি বা প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা নেই।'

'গত ১০ বছরে ২১ পণ্যকে জিআই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, এক বছরের মধ্যে ১০ পণ্যের জিআই দেওয়া হচ্ছে। যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা যদি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতেন তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।'

শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এর আগেও সম্ভাব্য জিআই পণ্যের জন্য আবেদন পড়েছিল। আমরা জার্নাল প্রকাশের আগে সব তথ্য ভালোভাবে যাচাই করেছি। সব শর্ত পূরণ করেছি।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেকোনো পণ্যকে জিআই মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।'

টাঙ্গাইল শাড়ির আবেদন এবং তিন দিনের ব্যবধানে জার্নাল প্রকাশের বিষয়ে তিনি বলেন, '... এটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করার বিষয় নয়।'

'তাড়াহুড়ো করে করা হলে ভুল থেকে যেতে পারে... যেসব পণ্যের জিআই নিয়ে বিতর্কের আশঙ্কা আছে, সেগুলোর নথি তৈরিতে বাড়তি শ্রম দিতে হয়।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Hopes run high as DU goes to vote today

The much-anticipated Ducsu and hall union elections are set to be held today after a six-year pause, bringing renewed hope for campus democracy.

5h ago