‘জয় বাংলা’ যেভাবে জনগণের স্লোগান হলো

পোস্টার: শিশির ভট্টাচার্যের মুক্তির গান

'জয় বাংলা' কখনোই কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না।

'বাংলার জয়' শব্দ দুটি ছিল বাঙালির ভাগ্য গঠনে চেতনা, ঐক্য, দেশপ্রেম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের নির্মম শোষণ, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের লড়াইয়ে এই আইকনিক স্লোগানটি অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

এই স্লোগান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে আজ আমরা গর্বভরে দেশের ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস পালন করছি।

'জয় বাংলা' ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে জনসাধারণের স্লোগানে পরিণত হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছে।

১৯২২ সালে ভারতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'পূর্ণ অভিনন্দন' কবিতায় এই শব্দগুলো লিখেছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে জেলে থাকার সময় এটি লিখেছিলেন।

কবিতার বিষয়বস্তু ছিল ঔপনিবেশিকতা, বিদেশি নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং 'জয় বাংলা' শব্দগুলো কিছুটা ভিন্নভাবে ব্যবহার করা হলেও পঞ্চম স্তবকে উপস্থিত হয়েছে, 'জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি -অন্তরীণ! জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!'

কবিতাটি ব্রিটিশ বিরোধী বীর পূর্ণচন্দ্র দাসকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন মাদারীপুরের একজন স্কুল শিক্ষক এবং কারাগারে নজরুলের সহবন্দী।

পূর্ণচন্দ্র বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার মুক্তি উপলক্ষে মাদারীপুরে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে পূর্ণচন্দ্র সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য কাজী নজরুলকে অনুরোধ করেন কালিপদ রায়চৌধুরী। কালিপদও কাজী নজরুলের সঙ্গে কারাবন্দী ছিলেন।

কবিতাটি পরে ১৯২৪ সালে তার কাব্যগ্রন্থ 'ভাঙার গান'-এ প্রকাশিত হয়।

১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি পান।

বিদ্রোহী কবি পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এক পৃষ্ঠার সান্ধ্য দৈনিক নবযুগে 'বাঙালির বাংলা' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।

১৯৪২ সালের এপ্রিলে (৩ বৈশাখ, ১৩৪৯) প্রকাশিত প্রবন্ধে কবি বাঙালিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

কবি লিখেছেন, 'বাংলা বাঙালির হক, বাংলার জয় হক, বাঙালির জয় হক'।

ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন দেশ—ভারত ও পাকিস্তান (পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে গঠিত)।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন শাসকদের অধীনে বাঙালিদের কাছে স্বাধীনতা অধরা থাকায় 'জয় বাংলা' ধীরে ধীরে স্লোগান হিসেবে পুনরুত্থিত হয়।

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস 'জয় বাংলা' স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গোপন ছাত্র সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ 'জয় বাংলা' নামে একটি হাতে লেখা সংবাদ প্রকাশ করত। (সিরাজুল আলম খানের স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ)

১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালীন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের দুই সদস্য—আফতাব উদ্দিন আহমেদ এবং চিস্তি শাহ হেলালুর রহমান—'জয় বাংলা' স্লোগান দেন।

ছাত্রলীগ নেতা আফতাব ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং চিস্তি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও দর্শনের শিক্ষার্থী।

আফতাবের 'জয় বাংলা' স্লোগান দেওয়ার একটি নিজস্ব পটভূমিকা ছিল।

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রউফের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন।

ফিরে আসার পর রউফ মধুর ক্যান্টিনে অন্যদের সঙ্গে তার সফরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, জিএম সৈয়দের নেতৃত্বে সিন্ধুতে একটি আন্দোলন চলছে এবং এর মূল স্লোগান ছিল 'জয় সিন্ধ'।

আলোচনার এক পর্যায়ে আফতাব বলেন, তারাও 'জয় বাংলা' ব্যবহার করতে পারেন। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে তিনি নিজেই স্লোগানটি দেন। (স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি: আবু সাঈদ খান)

এর মধ্য দিয়ে 'জয় বাংলা' আন্দোলিত হতে থাকে।

১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্ররা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সমাবেশে এই স্লোগান দেয়। সেখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন।

এর দুই সপ্তাহ পর ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে উচ্চারিত হতে থাকে 'জয় বাংলা' শব্দ দুটি।

সমাবেশ পরিচালনাকারী সিরাজুল আলম খান মঞ্চ থেকে বারবার স্লোগানটি দিতে থাকেন। (সিরাজুল আলম খানের স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ)

৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করে, যেখানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে 'স্বাধীনতার ইশতেহার' উন্মোচন করেন।

ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে, 'জয় বাংলা' হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান।

পরে বিতরণ করা লিফলেটের শিরোনাম ছিল 'স্বাধীনতার ইশতেহার: জয় বাংলা'। (মহিউদ্দিন আহমদের প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান)

১৯৭০ সালের ৭ জুন ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর নাম ছিল 'জয় বাংলা বাহিনী', যার প্রধান ছিলেন এএসএম রব। (বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র: কাজী আরেফ আহমেদ)

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সব সদস্যকে রাজপথে নামতে বলা হয়েছিল এবং পরিষদের সব সদস্যের কাছে নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাইক্লোস্টাইল পেপার 'জয় বাংলা' প্রকাশিত হয়েছিল।

নির্বাচন যতই ঘনিয়ে এসেছে, ততই 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'র বদলে সর্বত্র 'জয় বাংলা' স্লোগান দেওয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে—বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—বঙ্গবন্ধু যখন তার ১৯ মিনিটের মহাকাব্যিক ভাষণটি 'জয় বাংলা' দিয়ে শেষ করেছিলেন, এরপর থেকে স্লোগানটি ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। এই স্লোগান শুনে উপস্থিত জনতা গর্জে ওঠে নতুন উদ্যমে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার প্রথম বেতার ভাষণ শেষ করেন 'জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ' বলে। পরের দিন এটি রেডিওতে প্রচারিত হয়।

২০২২ সালের ২ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার 'জয় বাংলা'কে জাতীয় স্লোগান করে।

Comments

The Daily Star  | English

SC Secretariat Ordinance: Judges may hold executive posts

Lower court judges will be able to hold executive positions in the law ministry as well as state entities even after the establishment of a Supreme Court secretariat aimed at keeping the judiciary free from the executive’s influence, says a draft ordinance.

4h ago