বৈঠকখানার বুলবুলি

দেখতে সুন্দর ও নিরীহ মনে হলেও পক্ষীমহলে ‘লড়াইবাজ’ হিসেবে দুর্নাম আছে বুলবুলির। ছবি: রেনুকা

ঢাকা নামের এই নিদয় শহরের শিশুগুলো খাঁচার মতো ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট চৌহদ্দিতে এখন আপনমনে খেলে; একা একা। কিন্তু ফেলে আসা যূথবদ্ধতার কালে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে দল বেঁধে 'রস কষ শিঙাড়া বুলবুলি মস্তক' বলে একটা খেলা খেলতে দেখা যেত শিশুদের। অথচ শিঙাড়ার সঙ্গে বুলবুলির সম্পর্কটা আদতে কী—তা আজ অবধি অজানাই থেকে গেল।

আবার অন্য অনেক পাখি খেতের ধান খেয়ে গেলেও দুর্নাম হয় কেবল বুলবুলির। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দুষ্টু ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রচিত বিখ্যাত ছেলেভুলানো ছড়াটিতেও বলতে শোনা যায়, 'বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?'

'কূটকচালে' বাঙালি বর্গীদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে উৎপাদন কম হওয়ার দায় চাপিয়েছিল যে নিরীহ পাখিটির ওপর, এমনকি কোমলমতি শিশুদের কাছেও 'খলনায়ক' হিসেবে পরিচিত করেছিল যে ছোট্ট প্রাণকে, সেই বুলবুলিকেই সংসার পাততে দেখা গেল এই 'বিচ্ছিন্নতার' নগরের এক ফ্ল্যাটবাড়ির বৈঠকখানায়। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বসার ঘরের পর্দার আড়ালে।

দেখতে সুন্দর ও নিরীহ মনে হলেও পক্ষীমহলে 'লড়াইবাজ' হিসেবে খ্যাতি ও দুর্নাম দুটোই আছে বুলবুলির। এক সময় এদেশে পোষা বুলবুলির লড়াই হতো। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা আছে এই পাখিটির। নিজেদের মধ্যেও মারামারিতে সিদ্ধহস্ত এরা। আবার এদের মানুষের বাসস্থানের সুবিধাজনক জায়গায় বাসা বানানোর ঘটনাও বিরল নয়। তা সত্ত্বেও খোদ বসার ঘরে মানুষের এতটা ঘনিষ্ঠ পরিসরে বুলবুলি দম্পতির বাসা বানানোর বিষয়টি আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে ওই বাসার শিশুদের কাছে। এক্ষেত্রে পাখিদের সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকলেও এই শিশুদের প্রতিদিনের খেলার অংশী হয়ে উঠেছে এরা।

সপ্তাহখানেক ধরে সেখানে চলছে বুলবুলির বাসা বানানো এই প্রক্রিয়া। দিনের মধ্যে অজস্রবার ঘরের মধ্যে খড়কুটো নিয়ে আসা-যাওয়া করছে পুরুষ ও স্ত্রী বুলবুলি। পর্দার পেছনে বেশ গোলগাল-মজবুত চেহারাও পেয়ে গেছে বাসাটি। দুয়েকবার স্ত্রী বুলবুলিকে সেখানে বসে থাকতেও দেখা যাচ্ছে। যেন পরখ করে নিচ্ছে বাসার গঠন। এ সময় জানালার গ্রিলে পাহারায় থাকছে পুরুষ বুলবুলি।

বুলবুলি দম্পতির নতুন নীড়। ছবি: মামুনুর রশীদ

বুলবুলিদের বাসা তৈরির এই কাজ, পাশাপাশি এদের প্রেম ও প্রজননপ্রক্রিয়ায় যেন কোনোক্রমেই ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে কঠিন নজর রাখছে ওই ফ্ল্যাটের ছোট দুই সদস্য মৃন্ময়ী ও রেনুকা। ঘরের মধ্যে পাখিদের যাওয়া-আসায় যাতে অবাধ থাকে সেজন্য ঘোর ঝড়-বাদলেও জানালা বন্ধ করা হচ্ছে না। রাতে বৈদ্যুতিক আলোয় পাখিদের যেন অসুবিধা না হয় সেজন্য বসার ঘরের বাতি জ্বালানো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে তারা। এছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঘরের ফ্যান চালানোও বন্ধ আছে, যাতে পাখিদের আঘাত না লাগে। 

ওই ফ্ল্যাটবাড়িটির অবস্থান ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার উচারটেকে; 'প্রফেসরস হাউস' ভবনে। এলাকাটি ঢাকার আর দশটা এলাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ হলেও মূল সড়ক থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় সেখানে 'শব্দসন্ত্রাস' অনেকটা কম। গাছপালাও কিছুটা আছে। প্রফেসরস হাউসের ছাদে আছে ফল-ফুলের ছোট সাজানো বাগান। ফলে খাবারের জন্য বুলবুলিসহ এই শহরে টিকে থাকা অনেক পাখির আনাগোনা বেশ চোখে পড়ে সেখানে, গানের সুরও কানে আসে স্পষ্ট।

বুলবুলির সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন লেখক-চিন্তক আহমদ ছফা। তার নন্দিত উপন্যাস 'পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ'-এ খাবারে ঠোকর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তোলা বুলবুলির গানের সুরকে পাহাড়ি ঝরনার 'নরম ভেজা শব্দের' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি।

প্রফেসরস হাউসে শিক্ষক-সাংবাদিক দম্পতির ফ্ল্যাটে যে প্রজাতির বুলবুলিকে বাসা বেঁধেছে তা 'সিপাহি বুলবুলি'। এটি বোঝা গেল পুরুষ পাখিটির মাথার ঝুঁটিটি দেখে। এর চোখের নিচটায় টকটকে আলতার মতো রঙ। ঘাড় থেকে বুকের পাশ অবধি নেমে গেছে চওড়া কালো রঙ। বুক-পেট সাদাটে। পা ও ঠোঁট কালো। ঘাড়-পিঠ কালচে বাদামি।

সিপাহি বুলবুলির সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া যায় পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক শরীফ খানের লেখায়। সেখানে তিনি বলেন, 'আহারে সৌন্দর্য পাখিটির শরীরে! বেশি সুন্দর বোধ হয় মাথা-কপালের ওপরকার লম্বা-খাড়া চকচকে কালো রঙের ঝুঁটিটা। গলার তুলট-সাদা পালকগুলো ফুলে ফুলে দুলে দুলে ওঠে গান গাওয়া বা ডাকার সময়। সে এক দারুণ সৌন্দর্য!'

নতুন বাসাটিতে মাঝেমধ্যেই বসতে দেখা যাচ্ছে স্ত্রী বুলবুলিটিকে। ছবি: মামুনুর রশীদ

এই পাখির চালচলনেও আছে আভিজাত্য। মাথায় ঝুঁটির কারণে দেশের কোথাও কোথাও এটি 'রাজবুলবুলি' নামেও পরিচিত। পূর্ণবয়স্ক সিপাহি বুলবুলির দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার। ওজন ২০ গ্রামের মতো। কোকিল এদের বাসায় চুরি করে ডিম পাড়ে। ইংরেজি নাম রেড হুইস্কারড বুলবুল। বৈজ্ঞানিক নাম Pycnonotus jocosus.

অতি অল্পতেই অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে ওঠার স্বভাবও আছে এই পাখির। দাঁড়াশ, গুই, বেজি ও বনবিড়ালের মতো শত্রুকে এরা প্রবল বিক্রমে বাচ্চার সীমানা থেকে হটিয়ে দেয়। এমনিতে ভবঘুরে স্বভাবের। তবে বাসা বাঁধার পর এক জায়গায় থিতু হয়। মূল খাবার নানান রকম ছোট ফল, ফুলের মধুরেণু, পোকামাকড়সহ লার্ভা, শুঁয়াপোকা, গাছের বাকলের ফাঁকের পোকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে একটি পুরুষ্ট পোকা ঠোঁটে ধরে জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকতে দেখা গেল পুরুষ বুলবুলিটিকে। স্ত্রী বুলবুলিটি তখন সদ্য বুনন শেষ করা বাসায় বসে। শুরুতে খেতে না চাইলেও সঙ্গীর ঠোঁট থেকে ঠিকই খাবারটি নিতে দেখা গেল তাকে।

এর কোনোকিছুই চোখ এড়ায় না ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট দুই বাসিন্দার। বুলবুলি দম্পতির কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত বিস্মিত করে চলে তাদের। তারা অপেক্ষায় থাকে কবে ডিম দেবে পাখি। কবে ছানা ফুটবে। বাড়বে তাদের খেলার সঙ্গী।

শিশুদের এমন বিস্ময় আর অপেক্ষা মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দের 'পাখিরা' কবিতার কয়েকটি চরণ—'অনেক লবণ ঘেঁটে সমুদ্রের পাওয়া গেছে এ-মাটির ঘ্রাণ,/ভালোবাসা আর ভালোবাসার সন্তান,/আর সেই নীড়,/এই স্বাদ—গভীর—গভীর।'

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

3h ago