ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ: ড. কামাল হোসেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ড. কামাল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, 'সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট অভ্যূত্থানে ছাত্র-জনতার ইতিহাসকে ধারণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কোনো স্বৈরাচার আর মাথাচাড়া দিতে না পারে।'

আজ শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ড. কামাল হোসেন।

'অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার, সংবিধান বিষয়ে কর্তব্য ও গন্তব্য' শীর্ষক অনুষ্ঠান যৌথভাবে আয়োজন করে রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও আইনের কথা ডটকম।

ড. কামাল হোসেন বলেন, 'আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অধিকার অর্জন করি। কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ হওয়ার আগে এই অধিকার আমাদের প্রাণে রক্ষিত থাকে। ঠিক একইভাবে, ১৯৭১ এ আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার নিয়ে সংবিধান রচনা করেছিলাম, যেখানে বৈষম্য নিরসন এবং ধর্ম নিরপেক্ষতায় একটি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা একটা ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। একইসঙ্গে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার কোনো সুযোগ যাতে না থাকে সেই আলোকে সংবিধানের সংশোধনীর সুপারিশ তৈরি করতে হবে।'

'গত জুলাই আগস্ট মাসে আমরা যে ভয়াবহ ও কষ্টদায়ক ঘটনা দেখেছি, তা আমাদের অন্তরাত্মাকে নাড়া দিয়েছ' উল্লেখ করে কামাল হোসেন বলেন, 'আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং অজস্র নাগরিকের ওপর ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও দমন-পীড়ন এবং আইনের শাসনের প্রতি যে অবজ্ঞা আমরা দেখেছি, তা অবশ্যই আমাদের সংবিধানে স্থান পাওয়া উচিত।'

ড. কামাল হোসেন বলেন, 'আমাদের দায়িত্ব হলো সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন করা এবং চর্চা করা, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না হয়। আমরা যেন এই শিক্ষাগুলোকে আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোতে গেঁথে দিতে পারি, যাতে কোনো নাগরিকের সাথে অন্যায়, অবিচার আবার না ঘটে।'

তিনি আরও বলেন, 'এটাই হবে আমাদের সংবিধানের সত্যিকারের পরীক্ষা।'

অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ করেন সংবিধান গবেষক আরিফ খান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান খান।

মূল প্রবন্ধে সংবিধান গবেষক আরিফ খান বলেন, 'জুলাই মাসে সংগঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মহা-জাগরণ। এই জাগরণ আমাদের অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে গুরুতর ও আত্মঘাতী সব ভুলত্রুটির সংশোধন করে নিজেদেরকে পুনর্নিমার্ণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সামনে এনে দিয়েছে। জুলাই মহা-জাগরণ আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বসাম্প্রতিক রেনেসাঁ।'

আরিফ খান তার বক্তব্যে আরও বলেন, 'আমি এই জাতিরাষ্ট্রের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে উত্থিত, লালিত ও গৃহীত সাংবিধানিক আদর্শসমূহের ধারাবাহিকতার পক্ষে। তাই আমি সংবিধান সংস্কারেরও পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাংবিধানিক কাঠামো ও আদর্শকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সাংঘর্ষিক মতাদর্শকে লড়াকু অবস্থায় ঠেলে দেবে। ফলে তা জাতীয় জীবনে এক বিশাল শূন্যতা ও বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। তাই আমাদের বর্তমান কর্তব্য নির্ণয়ের প্রয়োজনে সংবিধান ছুড়ে ফেলা নয় বরং প্রয়োজন সাংবিধানিক রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের।

'আমরা যেন ভুলে না যাই, এই জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মুক্তির অভিপ্রায়ে যেসব রাষ্ট্রীয় আদর্শ আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রহণ করেছিলাম সেগুলোর ক্রমাগত অবমাননা, বিকৃতি, বিনাশ ও ধ্বংস সাধনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী গত পাঁচ দশকের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, সংবিধান নিজেই ফ্যাসিবাদের বিধ্বংসী ছোবলে রক্তাক্ত হয়েছে, খোদ সংবিধান কখনো ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি।'

ডা. জাহেদ উর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ কারণেই অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার।'

তিনি আরও বলেন, যারা সংবিধান পুর্নলিখনের কথা বলছেন তাদের অতি উৎসাহী হওয়ার যুক্তি দেখি না। কারণ পৃথিবীতে এমন কোনো দলিল নেই যা এনে বসিয়ে দিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাই সংবিধান সংস্কার হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।'

দ্বি-কক্ষ বিষয়ক সংসদের বিষয়ে জাহেদ উর রহমান বলেন, 'সংসদের নিম্নকক্ষ বর্তমান পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হতে পারে। আর উচ্চ কক্ষে যারা স্থান পাবেন তারা ওই নিম্নকক্ষের ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। এতে সংসদের নিম্নকক্ষ এবং উচ্চ কক্ষে এক ধরনের ব্যালেন্স হবে।'

আইনজীবী মু্স্তাফিজুর রহমান খান নির্বাচিত সরকারের হাতে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব দেয়ার পক্ষে মত দেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী মো. জুলফিকার ইসলাম। অনুষ্ঠানে রিডিং অ্যাসোসিয়েটস, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং নানা শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Act now, enough of silence

Israel is a threat to the civilised world as it breaks every international law, every human value,  all gains of our civilisation, all sense of decency and every norm of tolerance, and respect for others which lies at the root of our civilisation.

11h ago