কর্মসূচি প্রত্যাহারে ও সরকারের সঙ্গে সংলাপে চাপ দিয়েছিল ডিজিএফআই: নাহিদ ইসলাম

নাহিদ ইসলাম। ছবি: এএফপি

গত বছরের জুলাইয়ে কোটা আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে ও সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) চাপ দিয়েছিল বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় নাহিদ ইসলাম এ কথা জানান।

নাহিদ ইসলাম ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক। আজ বুধবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, 'গত বছরের ১৭ জুলাই যখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়, তখন তারা (ডিজিএফআই) আমাদের তথ্য পাঠিয়ে বলে যে, শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিমর্মতা-অত্যাচার তা বাড়বে যদি না আমরা সরকারের সঙ্গে আপস করি। তখন আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি যে, রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কোনো সংলাপে যাব না।'

জবানবন্দিতে নাহিদ বলেন, 'গুমের ঘটনায় আনেক অভিযোগ এসেছে। আমি নিজেও অভিযোগ দিয়েছি যে, ডিজিএফআইয়ের যে অফিসাররা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, হেনস্তা করেছিল, তারা যেন পার পেয়ে না যায়।'

সাক্ষ্যদান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নাহিদ বলেন, 'সেনাবাহিনী, র‍্যাবে এ যারা ছিলেন, রামপুরা-বাড্ডায় বিজিবির যে অফিসার গুলি চালিয়েছিলেন তাদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। এই অফিসাররা যেন পার পেয়ে না যায়। তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে।'

ট্রাইব্যুনালে নাহিদ ইসলাম বলেন, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১ নম্বর সমন্বয়ক ছিলাম। ২০১৮ সালে আমি প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই। ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল ওই আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। ছাত্রলীগ রাতের বেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে গিয়ে আক্রমণ করে। এ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন।'

'যদিও আমরা চেয়েছিলাম কোটা সংস্কার। কিন্তু সরকার কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করে। তবুও আমরা এটিকে আপাতত মীমাংসা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। এ ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও এই আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে এবং ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে। পরে সরকার কোটা বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করে,' বলেন তিনি।

নাহিদ আরও বলেন, 'আমরা আশঙ্কা করেছিলাম যে, কোটা প্রথা আবার ফিরে আসতে পারে। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারের কোটা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল করে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করেন। আমরা সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করি এবং রায়টি স্থগিত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মারকলিপি দেই। সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য আল্টিমেটাম দেই।'

'৩০ জুনের মধ্যে সরকার সাড়া না দেওয়ায় আমরা ১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ২০১৮ সালে জারিকৃত পরিপত্র পুনর্বহাল করে কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে আন্দোলন শুরু করি। ৪ জুলাই আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানির কথা থাকলেও সেদিন শুনানি হয়নি। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে,' বলেন তিনি।

সাবেক এই সমন্বয়ক বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বলে সরকারের কিছু করার নেই। কোনো বক্তব্য থাকলে তা আদালতে গিয়ে বলতে বলা হয়। তখন আমরা জানতাম বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সরকার পরিকল্পিতভাবে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে। সে কারণে আদালতে না গিয়ে আমরা রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখি। আন্দোলন তীব্র করতে ৭ জুলাই সারাদেশে "বাংলা ব্লকেড" কর্মসূচি ঘোষণা করি। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আমাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।'

'১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত না করে এক মাসের স্থিতাবস্থার আদেশ জারি করেন। আমরা এতে হতাশ হই এবং নিশ্চিত হই যে, বিচার বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। পরে আমরা দাবি কিছুটা পরিবর্তন করে সরকারি চাকরিতে সব পর্যায়ে কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কার দাবি করি। আন্দোলনের এ পর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই।'

নাহিদ বলেন, 'আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গেট ছাত্রলীগ বন্ধ করে দেয়, যেন ছাত্ররা আন্দোলনে অংশ নিতে না পারে। আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দেওয়া হয়। সারাদেশেই এ ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়। তবু সব বাধা অতিক্রম করে আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখি। সারাদেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করি।'

১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ওই রাতে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের "রাজাকারের বাচ্চা" এবং "রাজাকারের নাতিপুতি" অভিহিত করে কোটা প্রথার পক্ষে অবস্থান নেন। মূলত এই বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের বৈধতা দেওয়া হয়। "রাজাকারের বাচ্চা ও নাতিপুতি" আখ্যায়িত করায় সারাদেশের শিক্ষার্থীরা অপমানিত বোধ করে। ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ মুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিলো ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে।'

'১৫ জুলাই আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। একইদিন ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচির ডাক দেয়। সেদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন যে, আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তার এই ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে ব্যাপক নির্যাতন চালায়।'

'নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক হামলা চালানো হয় কারণ তারা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন। হামলাকারীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শয়ন, সাধারণ সম্পাদক সৈকত এই হামলায় নেতৃত্ব দেয়। তারা বাইরে থেকেও সন্ত্রাসীদের এনে জড়ো করে। এ হামলায় বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রছাত্রীদের ওপরও তারা নির্যাতন চালায় এবং চিকিৎসায় বাধা দেয়,' বলেন নাহিদ ইসলাম।

তিনি আরও বলেন, '১৬ জুলাই হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেই। সেদিন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৬ জন সেদিন শহীদ হন। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৭ জুলাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি দেই। তখন ইউজিসি দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয়।'

'সেদিন বিজিবি, পুলিশ ও র‍্যাব বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ফেলে। গায়েবানা জানাজা শেষে কফিন মিছিল শুরু করলে পুলিশ মিছিলে সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ আমাদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। সেদিন ডিজিএফআই আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করার এবং সরকারের সঙ্গে সংলাপের জন্য চাপ দেয়। হলের বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে সংলাপে আমরা অস্বীকৃতি জানাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানাই এবং ১৭ জুলাই রাতে দেশব্যাপী "কমপ্লিট শাটডাউন" কর্মসূচি ঘোষণা করি,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমাদের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই সারাদেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সেদিন রাজপথে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আমরা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জীবনের হুমকির মুখে পড়ি এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আমরা আত্মগোপনে চলে যাই। সেদিন সারাদেশে অনেক ছাত্রজনতা আহত ও নিহত হন, রাতে সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। একইভাবে ১৯ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। ১৯ জুলাই আমরা বুঝতে পারি যে, সরকার ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Shibli Rubayat, Reaz Islam banned for life in market over scam

In 2022, asset management firm LR Global invested Tk 23.6 crore to acquire a 51 percent stake in Padma Printers, a delisted company, from six mutual funds it manages

3h ago