দুর্গাপূজায়ও তাদের ঘরে আসছে না উৎসব

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। কিন্তু লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বহু দুস্থ পরিবারের কাছে এই উৎসব যেন বেদনার আরেক রূপ কেবল।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপ্টানা গ্রামের কান্দ্রি বালা (৬৬) জীর্ণশীর্ণ টিনের ঘরে ছেলে সুদান চন্দ্র রায়কে (৪২) নিয়ে বসবাস করেন। দিনমজুরির কাজ করে কোনোমতে সংসার চালালেও এখন কাজ নেই।
পূজার সময় যখন চারপাশে আনন্দ, নতুন পোশাক ও নানা পদের খাবারের আয়োজন; তখন কান্দ্রি বালার ঘরে খাবারও নেই, নতুন পোশাকের আশা তো স্বপ্ন।
কান্নাভেজা কণ্ঠে দ্য ডেইলি স্টারকে কান্দ্রি বালা বলেন, 'দুর্গাপূজা আইসলে মোর কষ্ট বাড়ে। কাজ নাই, ঘরোত খাবার নাই। কাপড়চোপড় কেনা তো দূরের কথা, খাবার কেনার শক্তিও নাই।'
তিনি বলেন, 'ঈদের সময় ভিজিএফ কার্ড দেয়, কিন্তু পূজার সময় হামাকগুলাক দেয় না। ভিজিএফ চাইল পাইলে তাও অ্যাকনা পূজার দিন ভাল করি কাটিল হই। কাই আর হামার খোঁজ নেয়।'
একই গ্রামের মনেশ্বরী বালা (৭০) বলেন, 'পূজার দিনোত কি খাইম তাও জানোং না। নাতি-নাতনিগুলার কাপড়ও নেওয়া হয়নি। সরকার ঈদে চাল দেয়, কিন্তু পূজার সময় কই?'
তিনি বলেন, 'এ্যালাতো হাতোত কামও নাই। কামাইও হবার নাইকছে না। পূজার দিনোত ঘরোত বসি কান্দা ছাড়া হামারগুলার আর গতি নাই।'
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্রপাড়ের জেলেপাড়ার বিষাদু দাস (৬৫) জানান, তাদের গ্রামের ৭০টি পরিবারের মধ্যে অন্তত ৬৫টি পরিবারই দুস্থ। পূজার সময় কাজ থাকে না, ফলে চড়া সুদে ধার করে সংসার চালাতে হয়।
তিনি বলেন, 'ভিজিএফ কার্ড পাইলে হামারগুলার উপকার হইত। পূজার দিনোত ঘরোত খাবার ব্যবস্থা হইল হয়।'
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দিনমজুর সুবল চন্দ্র বর্মণ (৫৫) জানান, এখন মাঠে কৃষিকাজ নেই। তাই তারা কর্মহীন। পূজার সময় সংসারের খরচ মেটাতে ধার করতে হয়। পরে সেই ধার শোধ করতে গিয়ে চরম সমস্যায় পড়তে হয়।
তিস্তাপাড়ের রাজপুর গ্রামের বিধবা সুনতি বালা (৬৭) নদীভাঙনে সব হারিয়ে অন্যের জমিতে একটি ঘর তুলে থাকেন। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, 'হামারগুলার পূজার আনন্দ নাই। ঘরোত খাবারও নাই। কাইও খোঁজও নেয় না। তিস্তা নদী হামাকগুলাক শ্যাষ করি দিছে।'
হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করেন, দুর্গাপূজার সময় দরিদ্রদের জন্য ভিজিএফ বরাদ্দ থাকা উচিত। পূজাকে ঘিরে বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়লেও আয়ের সুযোগ সীমিত। ফলে খাবার, পোশাক, পূজার সামগ্রী কেনা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে ওঠে।
লালমনিরহাট জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি হিরালাল রায় বলেন, 'মণ্ডপগুলোতে চাল সহায়তা দেওয়া হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুস্থদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। অথচ অনেক পরিবার পূজার সময় ঠিকমতো খাবারও জোটাতে পারে না।'
তিনি বলেন, 'উৎসবের আনন্দে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার যদি দুর্গাপূজার সময় বিশেষ ভিজিএফ সহায়তা চালু করে, তাহলে হাজারো কান্দ্রি বালা, মনেশ্বরী বা সুনতি বালাদের ঘরে অন্তত কিছুটা হাসির ঝলক দেখা যাবে।'
রংপুর বিভাগীয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) আবু জাফর বলেন, 'দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুস্থদের ভিজিএফ সহায়তা দেওয়া জরুরি। আমি জেলা প্রশাসক থাকাকালীন এ বিষয়ে লিখেছিলাম। আবারও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবো।'
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, 'দুর্গাপূজায় প্রতিটি মণ্ডপে ৫০০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভিজিএফ বরাদ্দ নেই। এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাব।'
তিনি বলেন, 'দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুস্থদের ভিজিএফ সহায়তা দেওয়া হলে তারা আনন্দে পূজা উদযাপন করতে পারতেন।'
Comments