‘সুসময়ে’ ব্রহ্মপুত্রপাড়ের ২১ হাজার জেলে পরিবারে দুর্দিন

নদে আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় হতাশ জেলেরা। ছবি। এস দিলীপ রায়

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ কেবল কৃষি ও নৌ-পরিবহনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি একসময় মাছের প্রাচুর্যের জন্যও সুপরিচিত ছিল। এই নদ ও এর শাখা–উপশাখায় দুই শতাধিক মাছের প্রজাতি পাওয়া যেত। এর মধ্যে অনেক প্রজাতি স্থানীয় খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে নদে মাছের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রপাড়ের প্রায় ২১ হাজার জেলে পরিবার নদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। জুন থেকে নভেম্বর—এই ছয় মাসকে জেলেরা নিজেদের 'সুসময়' বলে মনে করেন। কারণ এ সময় নদে প্রচুর মাছ মেলে। তখন সংসার চালানো, ঋণ শোধ, জাল ও নৌকা মেরামত এবং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করাও সম্ভব হয়। কিন্তু এ বছর সেই সুসময়েও জেলেদের দুর্দিন নেমে এসেছে।

চিলমারীর চর রাঘব এলাকার জেলে বিষাদু দাস বলেন, 'গেল বছর দিনে চার-পাঁচ কেজি মাছ ধরা যেত, এখন অর্ধেকও মিলছে না। পাঁচ বছর ধরে আশানুরূপ মাছ পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে নদ থেকে মাছ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই আমাদের সন্তানরা ধীরে ধীরে অন্য পেশায় ঝুঁকছে।'

চর বল্লভপাড়ার জেলে ঝোলা চন্দ্র দাস বলেন, 'একটি নৌকায় চার থেকে ছয়জন মিলে মাছ ধরতে যাই। আগে প্রত্যেকে দিনে দুই হাজার টাকার বেশি আয় করতাম। এখন ভাগে পড়ছে মাত্র সাত-আটশ টাকা। আমাদের জন্য এ সময়টা সুসময়, কিন্তু বাস্তবে তা দুর্দিনে পরিণত হয়েছে।'

উলিপুরের হাতিয়া এলাকার জেলে সুদান দাস বলেন, 'ব্রহ্মপুত্রকে বলা হতো মাছের খনি। এখন সেই নদই প্রায় মাছশূন্য। যদি মাছ সংরক্ষণ না হয়, তাহলে অচিরেই আমাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যেতে হবে।'

জেলেরা জানান, নদে এখনো কিছু রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙাস, মলা, চেপা, পুঁটি, দাড়িওয়ালা পুঁটি, রাঙা পুঁটি, দানিও, চেলা, বৈরালি, টেংরা, চিংড়ি, বাতাসি, পাবদা, চিতল, বোয়াল, শোল, গজার, রেইনবো স্নেকহেড ও কমলা দাগযুক্ত স্নেকহেড পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে বিলের কিছু প্রজাতির মাছও ধরা পড়ে। তবে এ প্রজাতিগুলোর পরিমাণও ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

জেলে ও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ব্রহ্মপুত্রে মাছ কমে যাওয়ার চারটি বড় কারণ তুলে ধরেছেন— জেগে ওঠা চরগুলোতে ভুট্টা ও অন্যান্য ফসল চাষে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহারে নদের পানি দূষিত হচ্ছে, এতে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। 

মৌসুমি শিকারিরা অবৈধভাবে চায়না দুয়ারি (মরণ জাল) ও ইলেকট্রিক ফিশিং পদ্ধতি ব্যবহার করে মা ও পোনা মাছ নির্বিচারে শিকার করছে। শুষ্ক মৌসুমে নদে গড়ে ওঠা অভয়াশ্রমগুলোও রক্ষা করা হচ্ছে না; বরং সেখানেও অবৈধ শিকার হচ্ছে। 'নো ফিশিং জোন' না থাকায় নদে মাছের নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র নেই, ফলে টেকসই মাছ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

চিলমারীর মনতলা চরের কৃষক সেকেন্দার আলী মণ্ডল বলেন, 'আগে চরে ফসল হতো সনাতন পদ্ধতিতে। রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের তেমন ব্যবহার ছিল না। কিন্তু গেল পাঁচ বছর ধরে  ভুট্টা আর আলু চাষ ব্যাপকহারে হচ্ছে। এ দুটি ফসলে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ভুট্টা ও আলুচাষ শুরু হওয়ার পর থেকেই নদে মাছ কমতে শুরু করেছে।'

কুড়িগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুক্তাদির খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চরে ফসল উৎপাদনে সার ও কীটনাশক ব্যবহার রোধ করা কঠিন। তবে ব্রহ্মপুত্রের ঘাটগুলোতে অন্তত তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নো ফিশিং জোন ঘোষণা করা গেলে মাছ কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। মৌসুমি জেলেদের অবৈধ জাল ও ইলেকট্রিক ফিশিং বন্ধ করা গেলে এবং শুষ্ক মৌসুমে অভয়াশ্রমগুলো সুরক্ষিত রাখা গেলে মাছের প্রজনন বাড়বে। আমরা এরইমধ্যে মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদে মাছ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka Customs House to remain open 24/7 over the next two days

The step has been taken to keep trade activities running after the Dhaka airport fire

1h ago