জুলাই সনদ: সই করছে না এনসিপি, বাকিদের যে অবস্থান

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আজকের প্রত্যাশিত জুলাই জাতীয় সনদ সই অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কয়েক মাসের আলোচনার পর গৃহীত সনদে তারা সই করবে না বলেও জানিয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপি ও তাদের সমমনা আটটি দল জানিয়েছে, তারা সনদে সই করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ৩০টি রাজনৈতিক দলের তিন দফা আলোচনার ফল এই জুলাই সনদ।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে সনদে সইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়নি। তবে দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, তাদের সইয়ের সম্ভাবনা জোরালো।
এনসিপি বলেছে, সংস্কারের জন্য গণভোট, সংস্কার প্রস্তাবের ভাগ্যগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠিক না হলে এখন সনদে সমর্থন দেওয়ার কোনো অর্থ হবে না।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ও যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন রাত দেড়টার দিকে দ্য ডেইলি স্টারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
রাসিন বলেন, 'জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। এ ছাড়া, নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বা গণভোটের প্রশ্নে কী হবে—সবই অজানা।'
তিনি আরও বলেন, 'সাংবিধানিক আদেশের ভাষাও আমরা জানি না। এসব কিছু না জেনে আমরা সনদে সই করছি না।'
পরে ফেসবুকে এনসিপির ফেসবুজ পেজে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, 'জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অংশগ্রহণ করবে না। এনসিপি মনে করে, এই সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোনো আইনি ভিত্তি অর্জিত হবে না। এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।'
এতে বলা হয়, এনসিপি বহুবার স্পষ্টভাবে আইনি ভিত্তির প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে। আইনি ভিত্তি নিশ্চিত হওয়ার পূর্বে এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা 'জুলাই ঘোষণাপত্রে'র মতো আরেকটি একপক্ষীয় দলিলে পরিণত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে বার্তায় বলা হয়েছে, 'এনসিপি কমিশনের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবে। দাবি পূরণ হলে পরবর্তীতে এনসিপি সনদ সই প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে।'
এর আগে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তাদের শর্তগুলো পূরণ না হলে তারা সনদে সই করবেন না।
তিনি বলেন, 'আইনগত ভিত্তি এবং সংবিধানিক আদেশের নিশ্চয়তা ছাড়া জুলাই সনদে সই করা অর্থহীন। এই কারণে এনসিপি বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে অংশ নেবে না।'
নাহিদ আরও বলেন, প্রস্তাবিত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া এবং গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, তা আগেই চূড়ান্ত করতে হবে এবং তা প্রকাশ করতে হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া 'জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়' অনুসারে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন।
তিনি আরও যোগ করেন, সনদে উল্লিখিত সমস্ত ৮৪টি সংস্কারপ্রস্তাবও গণভোটে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
এসব বিষয় স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সনদে সই কেবল আনুষ্ঠানিকতা। বিষয়গুলো স্পষ্ট না করে অনুষ্ঠানের দিকে এগোনো রাজনৈতিক রসিকতার সমতুল্য বলে মনে করেন নাহিদ।
মঙ্গলবার রাতে এনসিপি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে। সেখানে নেতারা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেন, সাংবিধানিক আদেশ জারি করে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া না হলে তারা সনদে সই করবে না।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নাহিদ ইসলামের। গতকাল আরও দুজন উপদেষ্টা নাহিদের সঙ্গে বসেন। কমিশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাত ১০টায় এনসিপি আহ্বায়ক ও অন্যান্য পার্টি প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিন ঘণ্টা দীর্ঘ আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার বিকেলে অনুষ্ঠেয় জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সই অনুষ্ঠান সব টেলিভিশন ও অনলাইন গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি দেশের জনগণের উদ্দেশে বলেন, 'যেখানেই থাকুন— বাড়িতে, পথে, দোকানে, কারখানায়, মাঠে কিংবা খেলাধুলার আসরে— সরাসরি সম্প্রচারে যুক্ত হোন এবং এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের অংশীদার হোন।'
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, 'আমাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা সবাই এক ও অভিন্ন জাতি।'
'এটি আমাদের একসঙ্গে উদযাপনের সময়— ঐক্যের শক্তি অনুভব করার সময়— গৌরব ও আশার এই ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন প্রেরণা সঞ্চয়ের সময়,' যোগ করেন তিনি।
এনসিপির জুলাই সনদে সই না করার সিদ্ধান্তকে তিনি দুঃখজনক বলে মনে করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, 'আমরা বুঝতে পারছি এটি তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা আশাবাদী যে, শেষমেশ তারা সনদে সই করবে।'
রীয়াজ আরও জানান, কমিশন সনদ সইয়ের পরই বাস্তবায়ন প্রস্তাব জমা দেবে।
এদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। রীয়াজ জানিয়েছেন, কমিশন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সরকারের কাছে একটি সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন প্রস্তাব উপস্থাপন করবে।
কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সনদ সই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছে দেন।
তারা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছেও আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আমন্ত্রণপত্র খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সচিবের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। জামায়াত আমির শফিকুর রহমান এবং এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকেও আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গঠিত কমিশনকে সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিশন এবং জনপ্রশাসনসহ ছয়টি প্রধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই দফা আলোচনার পর কমিশন ৮৪টি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে।
বিএনপি ও তাদের সমমনারা অন্তত নয়টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টস জমা দেয়। পরে সনদের খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। এরপরই তৃতীয় দফার আলোচনা শুরু করে কমিশন।
আলোচনায় দলগুলো সম্মত হয়, অ-সাংবিধানিক সংস্কার নির্বাহী আদেশ ও কার্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে, আর সংবিধানিক পরিবর্তন গণভোটে যাবে। যদিও গণভোটের বিষয়টি সবাই মেনে নিয়েছে, তবে এর সময়, প্রক্রিয়া ও কাঠামো নিয়ে একমত হয়নি।
তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বিএনপি সনদে সই করবে। দলের সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ দলের পক্ষে সই করবেন।
সালাহউদ্দিন, 'আমাদের পার্টির অবস্থান জুলাই চাটারে সইয়ের পক্ষে। আমরা সই করব। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হবে।'
কয়েকজন নেতা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, আশির দশকে এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সনদের ভূমিকা পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়নি, দলটি এই দাবি করেছিল।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, তাদের কিছু মূল উদ্বেগ এখনও সমাধান হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধান করা সম্ভব হলে তারা সনদ সই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আপত্তি দেখাবেন না।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সনদ সইয়ের পরও তা বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হবে।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ পিআর ব্যবস্থা এবং অন্যান্য দাবির জন্য একযোগে আন্দোলন করা সাতটি রাজনৈতিক দলও গত রাতে বৈঠকে বসেছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সনদ সইয়ের বিষয়ে প্রতিটি দল নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবে, একাধিক সূত্র বৈঠকের পর এমনটি নিশ্চিত করেছে।
এই দলগুলোর মধ্যে চারটি দল কমিশনের আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। বৈঠকের পর ইসলামী আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিশের নেতারা নিশ্চিত করেছেন যে তারা সনদে সই করবেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয়তাবাদী সম্মিলিত জোটের সমন্বয়কারী ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ুম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মহাসচিব মমিনুল আমিন, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান এবং গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান নিশ্চিত করেন, তাদের দল সনদে সই করবে।
বামপন্থী চার দল— বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি এবং বাসদ (মার্কসবাদী) এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছে, তারা সনদে সই করবে না।
বামপন্থী দলগুলো সংবিধানের ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করে।
Comments