সাংবিধানিক সংস্কারের ভিত্তি জুলাই সনদ

ছাত্র-জনতার ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে জুলাই সনদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে গণতন্ত্র ও জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে।
এর জন্য সংবিধানের তিন ডজনেরও বেশি অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজন হবে, যার মধ্যে বহু বিধান পরিবর্তন ও কয়েকটি নতুন সংযোজনের প্রস্তাব রয়েছে।
এ ছাড়া, অন্তত তিনটি অনুচ্ছেদ বাতিল করা হবে বলে জানানো হয়েছে ৮৪ দফা সংস্কার প্রস্তাব সম্বলিত এই সনদে।
৩০টি রাজনৈতিক দলের আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হওয়া এই সনদে সংবিধানের মৌলিক নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বড় ধরনের পরিবর্তনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী খসড়াটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি, তারা গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ারও অঙ্গীকার করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, এই সাংবিধানিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রকে আরও জবাবদিহিমূলক করা।
তিনি বলেন, 'আমরা এমন কোনো ব্যবস্থা রাখতে চাই না, যার মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে। আমরা চাই নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকুক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো হোক শক্তিশালী ও স্বাধীন।'
অনুচ্ছেদ বাতিল
বর্তমান সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, একটি প্রস্তাবনা এবং সীমান্ত, শপথ ও নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণকারী বেশ কয়েকটি তফসিল রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো ৭(ক), ৭(খ) অনুচ্ছেদ এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংযোজিত পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল বাতিল করতে একমত হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৭(ক) অনুযায়ী, অসাংবিধানিক উপায়ে সংবিধান বা এর কোনো বিধান বিলোপ, বাতিল বা স্থগিত করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য হবে।
অনুচ্ছেদ ৭(খ) সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে সংশোধন-অযোগ্য ঘোষণা করেছে—যার মধ্যে রয়েছে প্রস্তাবনা, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপরিচালনার মৌলিক নীতি সংক্রান্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত তৃতীয় ভাগ, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিধান ও অনুচ্ছেদ ১৫০।
অনুচ্ছেদ ১৫০(২) অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ পঞ্চম তফসিলে এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত টেলিগ্রাম ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সংযোজন
রাষ্ট্রপরিচালনার মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে যুক্ত হবে 'সমতা, মানব মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি'।
নতুন এই নীতিগুলো সম্পর্কে আলী রীয়াজ বলেন, 'এগুলো সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। এগুলো আগের মৌলিক নীতির সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে কিংবা সেগুলোর পরিবর্তে সংযোজন করা যেতে পারে।'
বর্তমানে সংবিধান চারটি মৌলিক নীতি ধারণ করে—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
নতুন করে বাংলাদেশকে বহু জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, 'এর মাধ্যমে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।'
সনদে মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, সেগুলোর সাংবিধানিক ও আইনি সুরক্ষা এবং কার্যকর বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ দেওয়া হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন ও বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংবিধানে নতুন বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
আরেকটি বিধানে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে—যার নিম্নকক্ষ হবে ৩০০ সদস্যের জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ হবে ১০০ সদস্যের।
জরুরি অবস্থার সময়ও নাগরিকদের অনুচ্ছেদ ৩৫ অনুযায়ী বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে অনুচ্ছেদ ৪৭(ক)-তে নতুন বিধান সংযোজন করা হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের সুযোগ রাখা হবে। এজন্য নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে অনুমোদন ও আনুষ্ঠানিক শুনানির প্রয়োজন হবে।
সংশোধন
অনুচ্ছেদ ৩ সংশোধন করে বাংলা ভাষাকে 'রাষ্ট্রভাষা' হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করা হবে এবং বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাগুলোকে 'জাতীয় ভাষা' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে 'বাঙালি' জাতি ও 'বাংলাদেশি' নাগরিক—এই বিভাজন তুলে দেওয়া হবে। সব নাগরিককে 'বাংলাদেশি' হিসেবে পরিচিত করা হবে।
বর্তমানে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই সংবিধান সংশোধন করা যায়। তবে সনদ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনের জন্য নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন হবে এবং কিছু ক্ষেত্রে গণভোটও বাধ্যতামূলক হবে।
রাষ্ট্রপরিচালনার মৌলিক নীতি, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ পরিবর্তনে গণভোটের প্রয়োজন হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, 'মূল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে সহজে পরিবর্তন করা থেকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে এই বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।'
অনুচ্ছেদ ২০(২) সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যাতে কোনো ব্যক্তি ব্যক্তিগত স্বার্থে 'সাংবিধানিক বা আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার' করতে না পারে।
অনুচ্ছেদ ১৪১(ক) সংশোধন করে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কারণ পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হবে—এক্ষেত্রে 'অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা'র পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে 'স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকি' শব্দগুলো।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য কেবল প্রধানমন্ত্রীর সই নয়, মন্ত্রিসভার অনুমোদনও প্রয়োজন হবে। এ সময় বিরোধীদলীয় নেতা বা তার মনোনীত প্রতিনিধি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন সংসদের উভয় কক্ষের যৌথ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। প্রার্থী ঘোষণার সময় তিনি রাষ্ট্র, সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কোনো পদে থাকতে পারবেন না।
অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো হবে। এর ফলে তিনি এককভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল, আইন কমিশন, জ্বালানি নিয়ন্ত্রক কমিশনের প্রধান ও সদস্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা পাবেন।
আরও সংশোধন এনে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হবে।

রাষ্ট্রপতি দণ্ডমুক্তির ক্ষমতা রাখবেন, তবে এর জন্য ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের সম্মতি বাধ্যতামূলক করা হবে। এ ক্ষমতার প্রয়োগ নির্ধারিত আইন, নীতি ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
দুটি নতুন বিধান সংযোজন করা হবে। একটি হলো, কোনো ব্যক্তি সর্বমোট ১০ বছরের বেশি সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না; মেয়াদের সংখ্যা যাই হোক না কেন। অপরটি হলো, প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না।
সংসদের উভয় কক্ষে বিরোধী দলের একজন করে সদস্যকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে মনোনীত করা হবে। প্রধান সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও বিভাগীয় কমিটিগুলোর সভাপতিও বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হবেন।
অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা হবে—তবে অর্থবিল ও আস্থাভোট এর বাইরে থাকবে।
একটি বিধান পরিবর্তন করে প্রধান বিচারপতিকে দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে স্থায়ী বেঞ্চ গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হবে।
অপর একটি নতুন বিধানে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া তদারকির জন্য একটি স্বাধীন বিচারক নিয়োগ কমিশন গঠনের অনুমোদন দেওয়া হবে।
নির্বাচনী কমিশন (ইসি), ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ তদারকি সংস্থাগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে বেশ কয়েকটি বিধান সংশোধন করা হবে। এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক সংস্থার মর্যাদায় উন্নীত করা হবে।
অতিরিক্ত বিধান অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইসির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় কর্মসূচির বাইরে থাকা ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'আমরা চেষ্টা করেছি যেন সংবিধানে স্বৈরতন্ত্রের কোনো সুযোগ না থাকে। কিন্তু, সেটা তো শুধু লিখে রাখলেই হবে না, বাস্তবায়নই আসল বিষয়। এর জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি।'
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এখনই এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আলোচনা চলছে, এখন কিছু বললে ভুলভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে।'
Comments