পদ্মায় পাখি দেখতে যাওয়া দম্পতির ক্যামেরায় ধরা পড়ল বিলুপ্ত মিঠাপানির কুমির

পদ্মার মাঝারদিয়া চরে বিরল 'লালমুনিয়া' পাখির ছবি গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও আলোকচিত্রী ইমরুল কায়েস ও তার স্ত্রী উম্মে খাদিজা ইভা।
সেখানে তাদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে বিরল প্রজাতির মিঠাপানির কুমির, যেটিকে অনেক বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) এ প্রজাতিটিকে আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
ইমরুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৫ সালের তালিকাতেও এই কুমিরকে বিলুপ্ত হিসেবে রাখা হয়েছিল। তবে ২০১৮ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতি বছরই এই কুমিরের দেখা পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।'

যেভাবে ছবিটি তুললেন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবাদী সংগঠন 'সেভ ওয়াইল্ডলাইফ অব নেচার'র সভাপতি ইমরুল জানান, গত ১৬ অক্টোবর বিকেলে মাঝারদিয়া চরে পাখির ছবি তুলতে গেলে তিনি জানতে পারেন যে, স্থানীয় এক রাখাল ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে বন বিভাগকে কুমির দেখার কথা জানিয়েছেন।
'বন বিভাগের কর্মকর্তারা আমাকে চিনতেন। কুমিরের খবর পেয়ে তারা সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সৌভাগ্যক্রমে আমরা তখন সেখানেই ছিলাম,' বলেন তিনি।
তিনি জানান, প্রায় ১৫ কিলোমিটার কাদা-পানিতে হেঁটে যান, কিন্তু শুরুতে কিছুই পাননি।
ইমরুল বলেন, 'হতাশ হলাম। শেষবারের মতো ড্রোন ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনই দেখতে পেলাম কুমিরটিকে। আমি ড্রোন ওড়ালাম, আর আমার স্ত্রী ক্যামেরায় সেই মুহূর্তটি বন্দি করলেন।'
তারা ড্রোন ও ক্যামেরা দুটো দিয়েই কুমিরটির ছবি তুলতে সক্ষম হন।
কুমিরটির বর্ণনা দিয়ে ইমরুল বলেন, 'এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো নিচের চোয়ালের দুটি দাঁত উপরের চোয়াল ভেদ করে বাইরে দেখা যায়।'
তিনি জানান, বাংলাদেশে একসময় তিন ধরনের কুমির ছিল—নোনা পানির, মিঠাপানির ও ঘড়িয়াল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কুমিরের চামড়া রপ্তানি শুরু হলে এদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও আইইউসিএনের কুমির বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাবনা, ফরিদপুর ও খুলনা জেলায় আগেও এমন কুমির দেখা গেছে। এর মধ্যে একটি উদ্ধার করে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।'
'ইমরুলের ছবিটি আমি দেখেছি। প্রায় ৯০ শতাংশ নিশ্চিত যে, এটি পুরুষ কুমির এবং বয়স কমপক্ষে ২০ বছর,' বলেন আদনান।
তবে এর জন্ম বাংলাদেশে নয় বলে মনে করেন এই কুমির বিশেষজ্ঞ। 'ভারতের চম্বল নদীতে এ প্রজাতির কুমির প্রচুর আছে। সম্ভবত এটি সেখান থেকে এসেছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'কুমির শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সূর্যালোকের ওপর নির্ভরশীল। তাই দীর্ঘ সময় নদীর তীরে রোদে শুয়ে থাকে। যদি এটি এখানে অনেকদিন থাকত, স্থানীয়রা আগেই টের পেত।'
'শীত আসছে, তাই এই কুমিরকে সূর্যের আলো নিতে তীরে উঠতেই হবে। এতে তারই বেশি ঝুঁকি। মানুষ ভয় পেয়ে এটাকে মেরেও ফেলতে পারে,' বলেন আদনান।
কুমিরটিকে রক্ষা করতে তিনি সংলগ্ন এলাকায় দ্রুত সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর আহ্বান জানান।
অপ্রত্যাশিত এই অভিজ্ঞতা ইমরুল ও তার স্ত্রীর মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। ইমরুল হাসতে হাসতে বলেন, 'গেলাম পাখি খুঁজতে, কিন্তু পেলাম হারিয়ে যাওয়া এক ইতিহাসের জীবন্ত রূপ।'
Comments