থমকে আছে ঢাকার ৪ নদী রক্ষার সরকারি প্রকল্প
ঢাকার চারটি নদীকে আগের রূপে ফেরাতে হাইকোর্টের নির্দেশের ১৬ বছর পার হলেও নদী দখল রোধে সীমারেখা চিহ্নিতকরণ ও হাঁটার পথ নির্মাণসহ অর্ধেক কাজও সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার।
২০০৯ সালের জুনে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর মূল সীমারেখা চিহ্নিত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। নদীগুলো দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করতেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
আদালতের এই আদেশের পর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) চার নদীর দুই তীরে ১০ হাজারেরও বেশি সীমারেখা পিলার বসানো ও ২২০ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তবে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের দুটি ধাপে এখন পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ ৭২ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ করেছে এবং ৬ হাজার ২০০টি সীমারেখা পিলার স্থাপন করেছে।
প্রথম ধাপে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীর নদীবন্দর এলাকায় ২০ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ এবং শ্যামপুর ও নারায়ণগঞ্জে দুটি ইকো-পার্ক তৈরি করা হয়। এতে সরকারের ব্যয় হয় ১৪২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে ২০১৮ সালে বিআইডব্লিউটিএ আরও ৫২ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ শুরু করে, যা এখনো অসম্পূর্ণ।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, টঙ্গীর কামারপাড়া থেকে ধউর পর্যন্ত, গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত, ফতুল্লা থেকে নিতাইগঞ্জ খালঘাট পর্যন্ত এবং বসিলা সেতু থেকে গাবতলী হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত হাঁটার পথ হবে।
রায়ে হাইকোর্ট ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসকদের ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ কেডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) ও রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) রেকর্ড অনুযায়ী নদী জরিপ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।
আদালত আরও নির্দেশ দেন, আইনগতভাবে লিজ দেওয়া জমি ছাড়া সব নদীর জমি ২০১০ সালের নভেম্বরের মধ্যে চিহ্নিত করে সীমারেখা পিলার বসাতে হবে, যাতে সরকার সেগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে বিআইডব্লিউটিএর চার নদীর তীরে ১০ হাজার ৮২০টি সীমারেখা পিলার স্থাপন, ৪৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদীতীর রক্ষা দেয়াল নির্মাণ এবং তিনটি ইকো-পার্ক ও কয়েকটি জেটি তৈরির কথা।
যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর মোহাম্মদ শাহনাওয়াজ কবির বলেন, 'আইনি জটিলতার কারণে দেড় বছর কাজ বন্ধ ছিল। বহু এলাকায় ভূমিদখলকারীরা আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে। যার কারণে আমাদের আবার হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চাইতে হয়।'
তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত প্রকল্পের (দ্বিতীয় ধাপের) ৮৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৬ হাজার ২০০টির মতো সীমারেখা পিলার বসানো হয়েছে এবং ৭২ কিলোমিটার হাঁটার পথ নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।'
২০১৮ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপ হাতে নেওয়া হলে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৪৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ২০২২ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছরের জুন পর্যন্ত করা হয় এবং ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সংশোধিত সময়সীমার মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় আরও বেড়েছে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, নতুন সময়সীমা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এবং ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। মূলত পরোক্ষ খরচ বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে ব্যয় বেড়েছে।
কাচপুর, শ্যামপুর, ধর্মগঞ্জ, রামচন্দ্রপুর ও টঙ্গী এলাকায় নদীর পাড়ে নির্মিত ২২ কিলোমিটার হাঁটার পথের অনেক অংশ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জানান, শ্যামপুর ও কদমতলী এলাকার হাঁটার পথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নাজুক হয়ে পড়েছে।
এই প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী শরীফ জামিল বলেন, '২০০৯ সালের আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের নামে আগের সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলো নদীর ভুল সীমারেখা নির্ধারণ করেছে এবং নামেমাত্র উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে তীরভূমি ও নদীর পাড় দখলকারীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।'
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা 'ধরা'র সদস্য সচিব শরীফ অভিযোগ করেন, 'হাঁটার পথ প্রকল্পটি মূলত দুর্নীতির হাতিয়ার। এর মাধ্যমে প্রকল্পের অর্থ ও নদী দখলকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হচ্ছে।'
'অব্যাহত দখল ও দূষণের কারণে নদীগুলো এখন ধীরে ধীরে সরু খালে পরিণত হয়েছে,' বলেন শরীফ।


Comments