জিরাফ-জেব্রা-বাঘের মৃত্যু, চুরি গেছে ম্যাকাও-লেমুর, সাফারি পার্কে ভালো নেই প্রাণীরা
অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও চুরির অভিযোগের মধ্যেই গাজীপুর সাফারি পার্কে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশুপাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩৭টি প্রাণী মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে। প্রাণিদের রক্ষা করতে ৩২টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সেইসঙ্গে জনবল ৬৯ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৩ জন।
ঢাকার অদূরে এই সাফারি পার্কের শেষ জিরাফটির মৃত্যুর পর অব্যবস্থাপনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। আফ্রিকার বয়স্ক মাদি জিরাফটি ২৩ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক রাজু আহমেদ জানান, ময়নাতদন্তে জানা যায় জিরাফটির যক্ষ্মা হয়েছিল।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন হাতেম সাজ্জাদ মোহাম্মদ জুলকারনাইনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারিক রহমান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি চুরি ও প্রাণী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দুটি গ্রিন-উইং ম্যাকাও চুরি হয়। এ বছরের মার্চে চুরি হয় তিনটি লেমুর। আর গত জানুয়ারিতে একটি নীলগাই পালিয়ে যায়। ২০২১ সালেও একই প্রজাতির আরেকটি প্রাণী পালিয়েছিল।
তবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ম্যাকাও দুটি এবং একটি লেমুর পরে উদ্ধার করে পার্কে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
তারিক রহমান বলেন, ৩,৬৯০ একর এলাকাজুড়ে থাকা পার্কের সীমানা প্রাচীর শক্তিশালী করার কাজ এখনো শুরু হয়নি, তবে পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হবে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট নিহাদ আদনান তাইয়ান যোগ করেন, নিরাপত্তা বাড়াতে একটি হেল্প ডেস্ক চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এদিকে, সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাণী মৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যায়; ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও আরেকটি সিংহ মারা যায়। ২০১৩ সালে আফ্রিকা থেকে ১০টি জিরাফ আমদানি করা হয়েছিল। প্রজননের মাধ্যমে এদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৩টিতে। কিন্তু এখন সবকটিই মৃত। ২০২১ সালে তিনটি ক্যাঙারু মারা যাওয়ার পর থেকে পার্কটি ক্যাঙারুশূন্য।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পার্কের প্রাণীদের বার্ধক্য ও দুর্বল কাঠামোর কারণে জিরাফের মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ছিল না, যদিও কিছু নতুন বাচ্চারও জন্ম হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, 'নিরাপত্তার কারণে আমরা এগুলো প্রচার করি না।'
কোর ইনচার্জ রাহুল পাল জানান, পার্কে বর্তমানে বাঘ, সিংহ, ভালুক, ওয়াইল্ডবিস্ট, নীলগাই, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, জেব্রা ও নায়ালাসহ প্রায় ১,৩০০ প্রাণী রয়েছে।
দর্শনার্থীরা বলছেন, একসময়কার প্রাণবন্ত পার্কটি এখন অনেকটাই নিস্তব্ধ। 'জিরাফ না থাকায় মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে', বলেন নাজমুল হাসান নামের এক দর্শনার্থী। টিকিট বিক্রেতারাও জানান, শুক্রবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে বিক্রি অনেক কমে গেছে। তারিক রহমানের তথ্য অনুযায়ী, পার্কে মাসে প্রায় ৩০ হাজার দর্শনার্থী আসেন।
প্রাণী অধিকার কর্মীরা সাফারি পার্কের এই ক্ষতির জন্য দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাকে দায়ী করেছেন।
অভয়ারণ্য অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়া আহমদ বলেন, 'বারবার জিরাফের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা।'
তিনি বলেন, আবাসস্থলের নকশায় দুর্বলতা, পেশাদার কর্মীর অভাব এবং সেকেলে সরঞ্জামের কারণে প্রাণি চিকিৎসকেরা অতিরিক্ত চাপে থাকছেন। এ কারণে তারা অনেক প্রাণীর যত্ন নিতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, পার্কের বিশাল এলাকাকে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার একটি মডেল বানানো যেত। এখানে খোলামেলা পরিবেশে বন্যপ্রাণীদের ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ রাখা যেত। কিন্তু দুর্বল পরিকল্পনা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে বেশিরভাগ জায়গাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
সঠিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করে বিদেশি প্রাণী আমদানিকে 'পরিবেশগতভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন' বলে অভিহিত করেন রুবাইয়া আহমদ।
কনজারভেশন বায়োলজিস্ট শাহরিয়ার সিজার রহমানও ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বিদেশি প্রজাতির প্রাণী আমদানিকে ভুল বলে মানতে রাজি নন। 'সঠিক যত্ন ও আবাসস্থল পেলে এমন প্রাণী অন্য দেশে ভালোভাবেই টিকে থাকে। সমস্যাটা এখানে তাদের উপস্থিতি নয়—সমস্যা হলো আমরা তাদের ভালোভাবে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি।'
তিনি দেশীয় বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন। 'বাংলাদেশে অগণিত দেশীয় প্রজাতি রয়েছে, যাদের সম্পর্কে মানুষ খুব কমই জানে। পার্কগুলোর উচিত তাদের পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দেওয়া।'
এদিকে, পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পার্কটি বন বিভাগের অধীনে থাকা উচিত হয়নি, যারা নিজেদের বন ব্যবস্থাপনা করতেই হিমশিম খায়।
'সাফারি পার্ক চালানোর জন্য ভিন্ন দক্ষতার প্রয়োজন', উল্লেখ করে তিনি একটি যৌথ সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনা মডেলের পরামর্শ দেন, যেখানে পেশাদাররা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এবং মালিকানা বিভাগের কাছে থাকবে।
রিজওয়ানা হাসান বিদেশি প্রাণী আমদানিরও বিরোধিতা করেন। 'আমরা যদি নিজেদের বন্যপ্রাণীর যত্ন নিতে না পারি, তবে কেন বিদেশি প্রজাতি আনব? সাইটিস (CITES)-এর অধীনে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, পাচার হওয়া প্রাণীদের তাদের মূল দেশে ফেরত পাঠাতে হয়, খাঁচায় প্রদর্শন করা নয়।'
তিনি বলেন, সরকার বিদ্যমান মডেলটি ঢেলে সাজাতে এবং সাফারি ও ইকো-পার্কের যৌথ ব্যবস্থাপনার অনুমতি দিতে বন্যপ্রাণী আইন সংশোধনের জন্য কাজ করছে, যা প্রাণীদের সংরক্ষণের সঙ্গে দায়িত্বশীল পর্যটনের সমন্বয় ঘটাবে। সংশোধনীটি দুই সপ্তাহের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।


Comments