ইউরোপ যাওয়ার ‘স্বপ্ন’ যেভাবে দুঃস্বপ্ন হলো

এএফপি ফাইল ছবি

চাঁদপুরের তরুণ আকবর সম্রাট (২৫) পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। গ্রিসে গিয়ে ভালো আয় করবেন—এই আশায় নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি করেছিলেন। চড়া সুদে ঋণও নিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে সময় লাগেনি। মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে কোনো রকমে জীবন নিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি।

আকবর জানান, তার প্রতিবেশী মোহাম্মদ শরীফ ও তার সহযোগী নাজির হোসেন তাকে বিদেশে লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখান। গ্রিসে পাঠানোর কথা বলে তারা ১৫ লাখ টাকায় রফা করেন। বিশ্বাস করে পাসপোর্ট ও নগদ ৮ লাখ টাকা তাদের হাতে তুলে দেন আকবর। গত জুলাই মাসে শরীফ তাকে ঢাকায় ১৪ দিন রাখার পর প্রথমে দুবাই এবং সেখান থেকে মিসর হয়ে লিবিয়ায় পাঠান।

লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরই শুরু হয় আসল বিভীষিকা। সেখানে সশস্ত্র মাফিয়া সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয় আকবরকে। কেড়ে নেওয়া হয় সব মালামাল। শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। আকবর বলেন, 'আমাকে অন্য পাঁচজনের সঙ্গে একটি বাংকারে আটকে রাখা হয়েছিল। তিন দিন কোনো খাবার বা পানি দেওয়া হয়নি।'

পাচারকারীরা আকবরকে একটি কারাগারের মতো একটি জায়গায় আটকে রেখে পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে। চক্রের সদস্য নাজির হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বাংলাদেশে আকবরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ছেলেকে বাঁচাতে আকবরের পরিবার জমি বিক্রি ও ধারদেনা করে আরও ১১ লাখ টাকা পাঠায়। কিন্তু টাকা পাওয়ার পরও মুক্তি মেলেনি। উল্টো তাদের লিবিয়ার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

অবশেষে ৪৫ দিন কারাভোগের পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় গত অক্টোবরের মাঝামাঝি দেশে ফেরেন আকবর। গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে আকবর বলেন, 'কিস্তি আর সুদের টাকার চাপে এখন দিশাহারা অবস্থা। পাওনাদাররা টাকার জন্য হুমকি দিচ্ছে। আমার এক ও চার বছরের দুটি ছেলেসন্তান আছে। জানিনা, কীভাবে এই সংকট থেকে বের হব।'

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানবপাচার প্রতিরোধ ইউনিটের (টিএইচবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে নাজিরের চক্রটি অন্তত ১৮ জনকে একইভাবে ফাঁদে ফেলেছে। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। গত বুধবার রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে চক্রের অন্যতম হোতা নাজিরকে (৫৫) গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডির টিএইচবি ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গ্রিসে পাঠানোর কথা বলে দুবাই ও মিসর হয়ে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করা হতো ভুক্তভোগীদের। এরপর চালানো হতো নির্যাতন। নাজিরের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অন্তত দুটি মামলা রয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, লিবিয়া ও গ্রিসে এই চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। পাচারকারীরা মুক্তিপণের টাকা জমা দেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক হিসাব নম্বর সরবরাহ করত। গ্রিসে থাকা সদস্যরা বিলাসী জীবনযাপনের ছবি দেখিয়ে প্রলোভন দেখাতেন। লিবিয়ায় জিম্মি করে টাকা আদায়ের পর ভুক্তভোগীদের প্রাণের ঝুঁকি তোয়াক্কা না করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পাঠানো হতো।

তদন্তকারীরা বলছেন, এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় কেউ কেউ ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেও, অনেকেই পথিমধ্যে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশকারীদের তালিকায় বাংলাদেশিরাই শীর্ষে রয়েছেন।

পুলিশ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর আরও জানান, সন্দেহভাজন পাচারকারী নাজিরের বাবাও একজন ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছেন বাংলাদেশিরা

ইউরোপীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ফ্রনটেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশকারীদের তালিকায় বর্তমানে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৮ হাজার ৩৪ জন বাংলাদেশি সাগরপথে ইতালিতে প্রবেশ করেছেন, যা গত বছরের তুলনায় বেশি। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ২৮৫।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা এবার নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে মাদারীপুর-শরীয়তপুর, সিলেট-সুনামগঞ্জ এবং নরসিংদী-ভৈরব এলাকার মানুষ এই পথে বেশি যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'শুধু চক্রের দু-একজনকে গ্রেপ্তার করলেই হবে না। নতুন তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মানুষকে বৈধ পথে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে, যাতে তারা অবৈধ পথের ঝুঁকি না নেয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Hasina can’t evade responsibility for Khaleda Zia’s death: Nazrul

In 2018, Khaleda walked into jail, but came out seriously ill, he says

4h ago