শীতে কাবু উত্তরের জনজীবন
কনকনে শীত আর হিমেল বাতাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জনজীবন। তীব্র ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশার কারণে দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা কাজে যেতে পারছেন না। একদিন কাজ না করলে যাদের চুলার আগুন জ্বলে না—তাদের দুর্ভোগ যেন আরও বেড়ে গেছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপ্টানা গ্রামের দিনমজুর কান্দ্রি বালা (৬০)। প্রতিদিন কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে কনকনে ঠান্ডার কারণে তিনি কাজে যেতে পারছেন না। কখনো শরীরজুড়ে কাঁথা মুড়ে, আবার কখনো খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুনে শরীর সেঁকে দিন কাটছে তার। খাবারের জন্য প্রতিবেশীর কাছে ধার করতে হচ্ছে।
কান্দ্রি বালা বলেন, 'এ্যালা খুব জার পইরছে। জারের ঠ্যালায় মুই ঘর থাকি। বাইরোত যাওয়ার সাহস পাবার নাইকছোং না। এ্যাদোন যদি বাইরোত যাই, তাক হইলে মোর অসুখ হইয়া যাইবে।'
তিনি আরও বলেন, 'জারের জন্যে মুই কামাই করতে পারছি না। মাইনসের কাছোত হাওলাদ করি চাইল-ডাইল কিনবার নাইকছোং।'
একই গ্রামের আরেক দিনমজুর ননী বালা (৬২) বলেন, 'একদিন কাম না করলে হামাকগুলাক উপাস থাকো নাগে। মঙ্গলবার থাকি কামোত যাওয়ার পাবার নাইকছোং না। কনকনে জার আর কুয়াশার জইন্যে বাইরোত যাওয়া মুশকিল।'
তার কণ্ঠে হতাশা আরও গভীর, 'হামারগুলার কম্বলও নাই। কাতা গাত দিয়া থাকা নাগে। কাম নাই, খাবার নাই। জারোত খালি কাঁপি।'
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা গ্রামের কৃষিশ্রমিক মকবুল হোসেন (৫৫) জানান, মাঠে কাজ থাকলেও ঠান্ডার কারণে কাজে যোগ দিতে পারছেন না।
'আইতোত জারের চোটে নিন্দে ধরে না। খুব কষ্ট করি। পেটের ভোগ তো আছেই। মাইনসের কাছে হাওলাদ করি সংসার চালবার নাইকছোং,' বলেন তিনি। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পরিবারের সবাই মিলে খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্রপাড়ের চর বেগমগঞ্জ এলাকার কৃষক সহিদার রহমান (৬৫) বলেন, ঠান্ডা আর কুয়াশার কারণে মাঠে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
'নিজে কাজে নামলেও বেশিক্ষণ মাঠে থাকা যাচ্ছে না। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কম্বল জড়িয়েও রেহাই মিলছে না,' বলেন তিনি।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর গ্রামের দিনমজুর সোলেমান আলী (৪৮) জানান, 'হামরা গরীব মানুষ। ঠান্ডা আর প্যাটের ভোগ একসাথে সহ্য করা মুশকিল। ঠান্ডার সময় হামারগুলার কষ্ট বেশি হয়। হামারগুলার জন্যে গরমের দিন ভালো।'
রংপুর নগরীর লালবাগ এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মমিনুল ইসলাম (৪০) বলেন, ঠান্ডার কারণে যাত্রী কমে গেছে।
'মঙ্গলবারের আগে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ টাকা আয় হতো। মঙ্গলবার আয় হয়েছে ২২০ টাকা, বুধবার ৩০০ টাকা। ঠান্ডায় মানুষ রিকশায় উঠতে চাচ্ছে না,' বলেন তিনি।
একই এলাকার কলেজ শিক্ষক আমজাদ হোসেন (৫৫) বলেন, 'আমাদের পর্যাপ্ত গরম কাপড় থাকলেও ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়ছি। সেখানে শীতার্ত দরিদ্র মানুষের কষ্ট আরও অনেক বেশি।' তিনি জানান, খুব প্রয়োজন না হলে নগরবাসী এখন রিকশায় উঠছেন না।
কুড়িগ্রামের বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, চরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছেন।
'তাদের গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। প্রতিদিন শতাধিক মানুষ কম্বলের আশায় আসছেন। কিন্তু ইউনিয়নের জন্য সরকারিভাবে মাত্র ১০০টি কম্বল পাওয়া গেছে, অথচ শীতার্ত মানুষ অন্তত তিন হাজার,' বলেন তিনি।
রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে— রংপুরে ১১ দশমিক ২, লালমনিরহাটে ১২, কুড়িগ্রামে ১১ দশমিক ৫, গাইবান্ধায় ১১ দশমিক ৮, নীলফামারীতে ১১, ঠাকুরগাঁওয়ে ১০ দশমিক ৭, সৈয়দপুরে ১০ দশমিক ৫ ও পঞ্চগড়ে ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে হিমেল বাতাস থাকায় শীতের প্রকোপ বেড়েছে। মঙ্গলবার থেকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৫ থেকে ১২ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। হিমালয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় রংপুর অঞ্চলে ঠান্ডা তুলনামূলক বেশি অনুভূত হয়। এই অবস্থা আরও কয়েকদিন থাকতে পারে।'


Comments