কনকনে শীতে বিপর্যস্ত উত্তরাঞ্চল, ব্যাহত কৃষিকাজ

ঠান্ডায় কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে রংপুর অঞ্চলের জনজীবন। ছবি: এস দিলীপ রায়

ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডায় কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে রংপুর অঞ্চলের জনজীবন। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। 

রাত–দিন চারদিক ঢেকে থাকছে কুয়াশার চাদরে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হিমেল বাতাস। শরীরজুড়ে উষ্ণ বস্ত্র জড়িয়েও ঠান্ডার হাত থেকে রেহাই মিলছে না। গ্রামাঞ্চলে শীতার্ত মানুষজন দল বেঁধে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে বাধ্য হচ্ছেন।

শীতার্তরা জানান, রংপুর অঞ্চল হিমালয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় এ এলাকায় শীতের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত আকাশে সূর্যের দেখা মিললে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে সূর্য যেন কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে গেছে। দিনভর সূর্য ঢেকে থাকায় শীতের তীব্রতা আরও বেড়েছে।

এই অবস্থায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা। মাঠে রয়েছে ভুট্টা, সরিষা, গম, আলু এবং আমনের বীজতলা। কিন্তু কনকনে ঠান্ডার কারণে তারা খেতে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। কেউ কেউ ঠান্ডা উপেক্ষা করে কাজে নামলেও বেশিক্ষণ টিকতে পারছেন না।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার মিলনপুর গ্রামের কৃষক নজির আলী জানান, ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। এখন খেতের পরিচর্যা জরুরি। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনজন শ্রমিক নিয়ে মাঠে নামলেও এক ঘণ্টাও কাজ করতে পারেননি। 

তিনি বলেন, 'আকাশে যদি সূর্য থাকতো, তাহলেও এত কাবু হতাম না। কিন্তু সূর্যই নেই। তাই ঠান্ডা সহ্য করা যাচ্ছে না।'

ঘন কুয়াশার প্রভাব পড়েছে নৌ, রেল ও সড়ক যোগাযোগেও। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, গঙ্গাধর, দুধকুমার, জিঞ্জিরাম ও ঘাঘট নদীর বিভিন্ন নৌরুটে নৌকা চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। রেলপথে ট্রেন চলছে ধীরগতিতে। সড়কেও যানবাহন চলছে সতর্কভাবে। দিনের বেলাতেও গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর নৌঘাটের মাঝি সহিদুল ইসলাম বলেন,'ঘন কুয়াশার কারণে সকাল ১০টার আগে কোনো নৌকা ছাড়ে না। দুপুরের পর চললেও খুব সাবধানে চালাতে হয়। বিকেল ৪টার পর নৌকা চালানো বন্ধ থাকে।'

রংপুর নগরীর মডার্ন এলাকার ট্রাকচালক শামসুল ইসলাম জানান, 'দিনের বেলাতেও পাঁচ মিটার দূরের কিছু দেখা যায় না। তাই হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হচ্ছে।'

সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন দিনমজুর, ছিন্নমূল ও নদীপাড়ের চর এলাকার মানুষজন। তাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত উষ্ণ কাপড় নেই। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহায়তাও মিলছে না বলে অভিযোগ তাদের। 

কম দামে উষ্ণ কাপড়ের আশায় তারা ভিড় করছেন শহরের ফুটপাতে বসা  দোকানগুলোতে। সেখানে ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় কম্বল, জ্যাকেটসহ কিছু উষ্ণ কাপড় মিললেও সবার পক্ষে কেনা সম্ভব হচ্ছে না।

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা এলাকার শীতার্ত দুস্থ বৃদ্ধা মনসুরা বেওয়া বলেন, 'একটা পুরোনো কম্বল আছে, তিন বছরের আগের। এটা দিয়ে শীত যায় না। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গিয়েও কম্বল পাইনি। কিনে নেওয়ার সামর্থ্যও নেই। খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছি।'

লালমনিরহাটের উত্তর সাপ্টান গ্রামের মনেশ্বরী বালা (৬৭) বলেন, 'একটা চাদর ছাড়া কিছুই নেই। ঠান্ডায় ঘর থেকে বের হতে পারছি না। এভাবে চললে অসুস্থ হয়ে পড়ব।'

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, তার ইউনিয়নে তিন হাজারের বেশি শীতার্ত মানুষ থাকলেও তিনি মাত্র ১০০টি কম্বল পেয়েছেন।

'এত অল্প কম্বল বিতরণ করতে গিয়ে চরম সমস্যায় পড়ছি। গেল বছরগুলোতে বেসরকারিভাবে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শীতার্ত দুস্থদের কম্বল দিতেন। কিন্তু এ বছর সেটা দেখছি না। সরকারিভাবে আরও কম্বল বরাদ্দ জরুরি,' বলেন তিনি।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় জানায়, শীতার্তদের জন্য রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা—লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধায় ৮৬ হাজার কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে আরও কম্বলের চাহিদা পাওয়া গেছে এবং অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রস্তুতি চলছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার জানান, প্রথম ধাপে পাঁচ হাজার ৬০০টি এবং দ্বিতীয় ধাপে আরও পাঁচ হাজার কম্বল পাওয়া গেছে।

'চাহিদা অনেক বেশি। আরও ৫০ হাজার কম্বলের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। আমি নিজে দুর্গম এলাকায় গিয়ে কম্বল বিতরণ করছি,' বলেন তিনি।

রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, শুক্রবার সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে—নীলফামারীতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রংপুরে ১১ দশমিক ৫, লালমনিরহাটে ১২, কুড়িগ্রামে ১১ দশমিক ৪, গাইবান্ধায় ১২ দশমিক ১, সৈয়দপুরে ১১ দশমিক ৪, পঞ্চগড়ে ১১ এবং দিনাজপুরে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে হিমেল বাতাস থাকায় শীতের প্রকোপ বেড়েছে। সূর্যের অনুপস্থিতিতে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও কমে গেছে। এই পরিস্থিতি আরও কয়েকদিন থাকতে পারে।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, ঠান্ডা ও কুয়াশার কারণে কৃষিকাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।

'কৃষকরা চেষ্টা করছেন কাজ চালিয়ে যেতে, তবে এ সময়ে কৃষিশ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে,' বলেন তিনি। 

Comments

The Daily Star  | English

Ocean of mourners gather to pay tribute to Khaleda Zia

Crowds spilled over into surrounding areas, with large gatherings seen in Farmgate, Karwan Bazar and nearby localities

2h ago