ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: চলমান এক আদর্শ
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা করা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুধু একজন চিকিৎসকই নন, ছিলেন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, ওষুধনীতি, নারীপ্রগতি ও সাম্যচিন্তার এক আজীবন যোদ্ধা।
১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ফিরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চরম হতাশায় পড়েছিলেন। যে নামে হাসপাতাল করতে চান, তা করতে দেওয়া হচ্ছে না; বিদেশি সহায়তা আনতেও বাধা; স্বাধীন দেশের আমলাতন্ত্র প্রতি পদে পদে দেয়াল তুলছে। তখনই তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল—'তাহলে আবার কী বিলেতেই ফিরে যাব? দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে না পারলে দেশে থেকে লাভ কী?'
তার বহু বন্ধু ততদিনে ফিরে গেছেন বিলেতে। তিনিও ভেতরে ভেতরে দোলাচলে।
এই দোলাচল ভেঙে দেয় এক রিকশাওয়ালার কথা—'স্যার, আপনারা না হয় বিলাতে যাইতে পারবেন, আমরা তো পারব না। আমগো কথা ভাববেন না?'
ডা. জাফরুল্লাহ নিজেই বলেছেন, এই কথাই তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়—তিনি কি পালিয়ে যাচ্ছেন? সেই মুহূর্তে তিনি ফিরে না গিয়ে লড়াইয়ে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি দেখা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান–এর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বলেন বড় হাসপাতাল বানানোর কথা। ডা. জাফরুল্লাহর জবাব ছিল স্পষ্ট—শুরু করতে হবে গ্রাম থেকে; গ্রাম না জাগলে বাংলাদেশ জাগবে না।
সেই দর্শন থেকেই জন্ম নেয় সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গ্রামভাবনা থেকেই এটি ঢাকায় না করে সাভারে করেন তিনি।
লন্ডনে রাজকীয় জীবনযাপনের সুযোগ ছেড়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। পরীক্ষায় বসেননি। আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে গড়ে তোলেন ৪৮০ শয্যার বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল—যার ধারাবাহিক রূপই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এখানেই তিনি বাস্তবায়ন করেন সামাজিক মালিকানার ধারণা—সবাই কর্মী, সবাই সমান। তার ভাষায় না হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন সবার বড় ভাই।
গণ বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, জাফরুল্লাহ ব্যক্তিগত মালিকানায় নয়, সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করতেন; তার কোনো প্রতিষ্ঠানই পারিবারিক নয়।
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারকে দিয়ে যুগান্তকারী ওষুধ নীতি করিয়ে তিনি বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ভিত্তি বদলে দেন। বহুজাতিক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে আজ দেশের ৯৭–৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত। তবু তিনি আজীবন বলতেন—ওষুধের দাম আরও কমানো সম্ভব। এই দাবির কারণেই তাকে স্মরণ করতে চায় না অনেক ওষুধমালিক প্রতিষ্ঠান; এমনকি একসময় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল।
চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির তার জীবন ও দর্শন নিয়ে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র মোহনা।
রাজকীয় জীবন ছেড়ে সবহারাদের পাশে দাঁড়ানো এই মানুষটি মানুষের শরীরের রোগ নয়, সমাজের রোগ সারাতে চেয়েছিলেন।
আজ ২৭ ডিসেম্বর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্মদিন। এই দিনে তিনি তাই কেবল স্মৃতির মানুষ নন—তিনি এখনো চলমান এক আদর্শ।


Comments