২০২৫ সালে গণপিটুনিতে ১৬৬, রাজনৈতিক সহিংসতায় ৮৬ জন নিহত: এমএসএফ
২০২৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনি, হেফাজতে মৃত্যু, অজ্ঞাত পরিচয়ের মরদেহ উদ্ধার এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিসংখ্যানভিত্তিক এ পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়েছে সংগঠনটি।
আজ বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে এমএসএফ।
সংগঠনটি জানায়, গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমাগত সংকুচিত হওয়া, জবাবদিহির অভাব এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এমএসএফ জানায়, সারা বছরজুড়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বেড়েছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ অব্যাহত ছিল। এছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইন ও অধ্যাদেশের আওতায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনি হয়রানিও ছিল চলমান।
সংগঠনটি আরও দাবি করে, বহু মানুষকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। যা গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত ও নাগরিকদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের সক্ষমতা সীমিত করেছে।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৯৯টি ঘটনায় মোট ৫ হাজার ৬০৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮৬ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৫১৮ জন আহত হন, যাদের মধ্যে ৯৭ জন ছিলেন গুলিবিদ্ধ।
নিহতদের মধ্যে ৬৫ জন বিএনপি সদস্য, ৮ জন আওয়ামী লীগ সদস্য, ৩ জন জামায়াতে ইসলামীর সদস্য এবং ১০ জন সাধারণ নাগরিক ছিলেন, যাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর মনোনয়ন ও প্রচারণা সংশ্লিষ্ট ২৬টি ঘটনায় ২৫২ জন ক্ষতিগ্রস্ত হন—এর মধ্যে ৩ জন নিহত ও ২৪৯ জন আহত হন।
এছাড়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার ১৬৯টি ঘটনায় ২৩৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হন, যাদের মধ্যে ৪৭ জন নিহত ও ১৮৭ জন আহত হন।
এমএসএফ জানায়, সরকার পতন ও জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত ঘটনায় এ বছর ৬৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৭ হাজার ৭৮০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং আরও ১১ হাজার ১৭৯ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম রয়েছে বলে জানায় সংগঠনটি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতন সংক্রান্ত মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ৩ হাজার ৬৯৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে এমএসএফ জানায়। দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এসব গ্রেপ্তার করা হয়।
এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া যৌথ বাহিনীর 'অপারেশন ডেভিল হান্ট'-এর আওতায় ২২ হাজার ২৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের মধ্যে ১১ হাজার ৩১৩ জনকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এমএসএফ জানায়, এ বছর বিশেষ পুলিশ অভিযানসহ বিভিন্ন মামলায় সারা দেশে মোট ২ লাখ ১২ হাজার ৮০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিছু মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত হলেও উচ্চ ও নিম্ন আদালতে এখনও প্রায় ৪৫ লাখ ২০ হাজার মামলা ঝুলে রয়েছে, যা সময়মতো বিচার পাওয়া কঠিন করে তুলছে।
এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল বলে জানায় এমএসএফ। ২০২৫ সালে 'ক্রসফায়ার' বা বন্দুকযুদ্ধের অন্তত ১৯টি ঘটনায় ২২ জন নিহত ও ১৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ৮টি যৌথ অভিযানে ১২ জন নিহত হন। অন্য ঘটনাগুলোতে কোস্ট গার্ড, বিজিবি, র্যাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পৃথক অভিযানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও বেড়েছে। এ বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য রেকর্ড করেছে এমএসএফ। এর মধ্যে ২ নারীসহ থানা হেফাজতে মৃত্যুর ৬টি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলা হয়েছে।
এছাড়া গ্রেপ্তারের ভয়ে পালানোর সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়ায় ৮ জন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। যাকে সংগঠনটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে।
২০২৫ সালে কারাগারে ১১৬ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় এমএসএফ। এর মধ্যে ১১২ জন অসুস্থতায় মারা যান। এছাড়া ১ জন আত্মহত্যা করেন, ১ জন গণপিটুনির পর মারা যান, ১ জনের মৃত্যু রহস্যজনক এবং ১ জন নির্যাতনের ফলে মারা যান। অসুস্থতায় কারাগারে ২ জন ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুর তথ্যও পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ৪১ জন দণ্ডপ্রাপ্ত, ৭৩ জন বিচারাধীন বন্দি এবং ১ জন নারী বিচারাধীন বন্দি ছিলেন, যিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানানো হয়।
চলতি বছর সাংবাদিকরাও চাপের মুখে ছিলেন বলে জানায় এমএসএফ। এ বছর ২৮৯টি ঘটনায় ৬৪১ জন সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর মধ্যে ১ জন নিহত হন, ২৯৫ জন হামলার শিকার বা আহত হন, ১৬৩ জন হুমকি বা অপমানের শিকার হন এবং ১৭০টি আইনি হয়রানির ঘটনা ঘটে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪৬টি মামলা হয় এবং ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া ১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলার ঘটনাও উল্লেখ করে সংগঠনটি।
নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও 'উদ্বেগজনক' হারে বেড়েছে বলে জানায় এমএসএফ। এ বছর নারীদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ১৪টি এবং শিশু ও কিশোরীদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৯২৮টি সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ৯২টি ঘটনাও নথিভুক্ত করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য কম।
এমএসএফ জানায়, 'মব ভায়োলেন্স' বা সংঘবদ্ধ সহিংসতায় গণপিটুনির ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ বছর ৪২৮টি গণপিটুনির ঘটনায় ১৬৬ জন নিহত এবং ৪৬০ জন আহত হন।
পাশাপাশি ৬৪১টি অজ্ঞাত পরিচয়ের মরদেহ উদ্ধারকে 'চরম নিরাপত্তাহীনতা'র ইঙ্গিত হিসেবে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে সরকারকে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের আহ্বান জানায় এমএসএফ।
পাশাপাশি সাংবাদিক ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা জোরদার, কারাগারে স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণ, জবাবদিহিমূলক পুলিশিংয়ের মাধ্যমে 'মব ভায়োলেন্স' বা গণপিটুনি রোধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন শক্তিশালী করার সুপারিশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এমএসএফের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, প্রকল্প সমন্বয়ক মোহাম্মদ টিপু সুলতান এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা তানিনা খাতুন।


Comments