‘অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট’ রাজনীতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ‘জাতীয় ছাত্রশক্তি’
আবার 'ছাত্রশক্তি' নামটি ফিরে এসেছে দেশের ছাত্ররাজনীতির অঙ্গনে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) বিলুপ্ত করে গঠন করা হয়েছে 'জাতীয় ছাত্রশক্তি'।
গত ২৩ অক্টোবর বাগছাস পুনর্গঠন ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয় সমন্বয় সভায় কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার এ ঘোষণা দেন।
ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় ৯ মাস আগে আত্মপ্রকাশ করা 'গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি'র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব ছিলেন বাকের। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অভ্যুত্থানের আগে ক্যাম্পাসে আমরা "গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি"র ব্যানারে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছি, আগ্রাসনবিরোধী রাজনীতি করেছি। আমরা বাংলাদেশপন্থী ও মধ্যমপন্থী রাজনীতিকে সামনে আনতে চাই।'
২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু ভবনের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছিল 'গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি'। চিন্তা বিনির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা ছিল সংগঠনটির মূল লক্ষ্য।
আত্মপ্রকাশের কয়েকঘণ্টার মধ্যেই 'গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি'র নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ)। টিএসসিতে সমাবেশ শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন সদ্য গঠিত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক আখতার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন।
সেদিনের ওই সমাবেশে আখতার বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনদের ভয় দেখানোর চর্চার বিরুদ্ধে অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই করবে ছাত্রশক্তি। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবাইকে সংঘবদ্ধ হতে হবে।
এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার, প্রশাসনের অন্যায় আচরণ, ছাত্রলীগের হামলা ও নিপীড়নের প্রতিবাদসহ ক্যাম্পাসগুলোতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের দাবিতে একের পর এক কর্মসূচি দেয় সংগঠনটি।
বাকের বলেন, '২০২০ সাল থেকে আমরা গবেষণা, পাঠচক্র, কর্মসূচির মাধ্যমে প্রস্তুত হয়েছি। আমাদের পলিটিক্যাল ফিলোসফি ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ এবং সব নাগরিককে সমান মর্যাদা দিতে চাই। আর এজন্য প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। একটা আন্দোলন কীভাবে বড় করা যায় এই চেষ্টা ছিল আমাদের। ২০২৪ সালে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলো তখন আর বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি।'
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, বাকের মজুমদার, আব্দুল কাদের, নুসরাত তাবাসসুম, আব্দুল হান্নান মাসউদদের সমন্বয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। নব্যগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন নাহিদ ও আসিফ।
এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি তার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলের সদস্য সচিব হন আখতার হোসেন।
এর মধ্যেই ২৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় নতুন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), যার কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হন বাকের মজুমদার ও ঢাবি কমিটির আহ্বায়ক হন আব্দুল কাদের।
গঠনের মাত্র ৮ মাসের মাথায় সংগঠনের নাম বদলে 'জাতীয় ছাত্রশক্তি' দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাকের বলেন, 'এটাকে রিব্র্যান্ডিং বলা যেতে পারে। এই সময়ে সংগঠনে অনেকে ঢুকেছে, অনেকে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। আমরা সবাইকে ধরে রাখার জন্য একটা পর্যায় পর্যন্ত গ্রহণ করেছি। এবার আমরা আমাদের পলিসিগত জায়গায় কিছু পরিবর্তন আনব। আমাদের লিডারশিপে কিছু পরিবর্তন আসবে।'
'আমরা আমাদের কর্মশালাগুলোর পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনব। আমাদের রাজনৈতিক দর্শনকে কালচারালি রূপান্তরের চেষ্টা করব। আমরা বলেছি এনসিপি হবে আমাদের আদর্শিক সহযোগী সংগঠন,' বলেন তিনি।
এনসিপির সঙ্গে জাতীয় ছাত্রশক্তির সম্পর্ক কেমন হবে, ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'আদর্শিক সহযোগী মানে মাদার পার্টি না, তাদের কোনো প্রভাবও থাকবে না আমাদের পলিসিতে। আমাদের পলিসি হবে আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে। আমরা মনে করি এনসিপি যে ধারার রাজনীতি করে, তাদের আদর্শিক ধারা আর আমাদের আদর্শিক ধারা এক। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নেবো। নিজেদের পলিসি নিজেরা ঠিক করব। আমাদের লিডারশিপ এমন হবে যে কখনো কোনো বিষয়ে কম্প্রোমাইজ করব না।'
বাকের মজুমদার আরও বলেন, 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের কয়েকজন প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারের থাকায় আমাদের বিষয়ে জনমনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, আমরা বোধহয় সরকারি ছাত্র সংগঠন। অথচ গত ৮ মাসে আমরা নিজেরাও এভাবে চিন্তা করিনি। আমাদের রাজনৈতিক গতিপথ অ্যান্টি-স্টাবলিশমেন্ট, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান বা প্রশাসন বিরোধী রাজনীতিটাই আমাদের আদর্শের সঙ্গে অনেক বেশি কানেক্টেড। এই বিরোধী রাজনীতিটা করতে পারলে শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে বেশি এনগেজ হবে। আমরা মনে করি, যে এস্টাবলিশমেন্ট এখন বাংলাদেশে আছে সেটা জনগণের কল্যাণ বয়ে আনতে পারছে না। এজন্য আমরা অনেক কিছু পরিবর্তন চাই, আমাদের অনেক কাজ বাকি। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যে লড়াই ছিল সেটারই কন্টিনিউয়েশন করে যাবে জাতীয় ছাত্রশক্তি।'
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বাকের বলেন, 'পুনর্গঠনের প্রথম পর্যায়ে আমরা জেলা সফর করব, দ্বিতীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক জায়গায় কিছু কাজ করব। আমাদের এখন সাংগঠনিক অঞ্চল ১৪টি, এটা কমিয়ে ১০টি করা হবে। প্রতিটা অঞ্চলে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবেন, একজন থাকবেন প্রধান সংগঠক, সাংগঠনিক সম্পাদক থাকবেন। সংগঠনের ইন্টারনাল কালচার বিল্ড করার প্রসেস দেখাশোনা করবেন সেক্রেটারি, আর প্রেসিডেন্ট আমাদের পলিটিক্যাল লাইনটাকে ভিজিবল রাখতে কাজ করবেন।'
২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি আত্মপ্রকাশের দিন লিখিত বক্তব্যে নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, 'দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশে নতুন ছাত্ররাজনীতি দরকার, যা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করবে এবং যার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে।'
সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অ্যাকটিভিস্ট, লেখক ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী তুহিন খান। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি থেকে যাত্রা শুরু করে এখন জাতীয় ছাত্রশক্তির আত্মপ্রকাশকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাতীয় ছাত্রশক্তির ভালো করার কথা।'
'একটা রেজিস্টেন্স ফোর্স হিসেবেই ছাত্রশক্তি আসলেই কার্যকর একটা সংগঠন ছিল। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, তাদের কোনো মাদার পার্টি ছিল না। মাদারপার্টির কারণে ছাত্রসংগঠনগুলো স্বাধীনভাবে তার কাজ করতে পারে না। এখন জাতীয় ছাত্রশক্তি যদি সেই জায়গাটা তৈরি করতে পারে, ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, অর্থাৎ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার চাইতে একটা প্রতিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করে যেতে পারে, তাহলেই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির প্রকৃত লক্ষ্যের দিকে তারা এগিয়ে যাবে। তবে প্রকৃতপক্ষে তারা কী করবে, সেটা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমেই দেখা যাবে।'


Comments