ক্ষমতার ভারসাম্য আসবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে

জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কারই ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তনের পাশাপাশি অন্যতম প্রধান সংস্কার হলো প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
বহু বছর ধরে সমালোচকরা সতর্ক করে আসছেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিরিক্ত সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকায় স্বৈরতন্ত্রের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং রাষ্ট্রপতির পদটি কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে বাস্তবে ক্ষমতাহীন হয়ে আছে।
জুলাই সনদে প্রধানমন্ত্রীর এমন সর্বগ্রাসী ক্ষমতা সীমিত করা ও রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'ভবিষ্যতে যেন আর কোনো ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা গড়ে না ওঠে, সেজন্য ক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি।'
রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে সরকার প্রধানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া রোধে কার্যকর কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আসছে।
আলী রীয়াজ বলেন, 'প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই প্রধানমন্ত্রীর একক নিয়ন্ত্রণাধীন। রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করতে বাধ্য। কার্যত রাষ্ট্রপতির নিজের কোনো ক্ষমতাই নেই।'
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ১৯৯১ সালে ১২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তন করা হয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী হন সরকারের নির্বাহী প্রধান এবং রাষ্ট্রপতি হন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান।
বর্তমানে রাষ্ট্রপতির পদ মূলত অলংকারিক। প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি একাধারে নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন, আইনসভায় ব্যাপক প্রভাব রাখেন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপরও পরোক্ষ আধিপত্য বজায় রাখেন।
আর রাষ্ট্রপতি প্রায় সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন।
জুলাই সনদ কী বলছে
জুলাই সনদে রাষ্ট্রপতিকে স্বাধীনভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, আইন কমিশন, জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি ও কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে।
সনদ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেবেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নিয়োগের এই প্রক্রিয়াকে তাৎক্ষণিক ও জবাবদিহিতাহীন বলে ভিন্নমত জানিয়েছে। তারা আরও শক্তিশালী ও স্বচ্ছ কাঠামো নিশ্চিত করতে আইনি ব্যবস্থা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি প্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও সংসদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নিযাম আহমেদ বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত করা হলেও কোনো সমস্যা হবে না।'
তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগের প্রস্তাবকেও স্বাগত জানান।
সনদে প্রস্তাব করা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হবেন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের পদে থাকা ব্যক্তি এই পদে প্রার্থী হতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ বা কমানোর ক্ষমতা রাখবেন। তবে এই ক্ষমতা আইন দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, 'রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা বাড়ানো হলেও, তাকে একই সঙ্গে একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামোর আওতায় আনা হবে।'
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
সনদ অনুযায়ী, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে যে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
সনদে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না। তবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এ বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, 'উদ্দেশ্য হলো, দল ও সরকারের মধ্যে সীমারেখা রাখা, যাতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হয়।'
এতদিন একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের পদে থেকে সরকার, সংসদ ও দল—তিনটিই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদেও কোনো সীমা ছিল না।
নিযাম আহমেদ বলেন, 'শেখ হাসিনা সরকারের অভিজ্ঞতা থেকেই প্রস্তাবিত ১০ বছরের মেয়াদসীমার আলোচনা এসেছে। এই পরিবর্তনটা আমাদের জন্য জরুরি।'
তবে তিনি সতর্ক করেন, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ আলাদা করার প্রস্তাবটি দীর্ঘমেয়াদে কিছু ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, 'এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে দলীয় কাঠামো দুর্বল হতে পারে। শক্তিশালী রাজনৈতিক দল না থাকলে গণতন্ত্রও টিকবে না।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'যেসব বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা অনিশ্চিত। যদি না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশিত ক্ষমতার ভারসাম্য কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।'
তিনি বলেন, 'জুলাই সনদে অনেক তাত্ত্বিক ধারণা আছে। কিন্তু, বাস্তবে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।'
Comments