নারীকে গণধর্ষণের হুমকি: বিশ্ববিদ্যালয় কি সহিংসতার প্রশিক্ষণশালা

ডাকসু নির্বাচন ফিরেছে। ফিরেছে জাকসু, রাকসু। সঙ্গে ফিরেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির উত্তাপ, মতবিনিময়ের সুযোগ, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ বার্তাটি হলো, নারী নেতৃত্ব মানেই এখন হুমকি, অপমান ও ধর্ষণের ভয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী প্রার্থী, যিনি আদালতে রিট করেছিলেন, তাকে প্রকাশ্যে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষার্থী লিখেছে, 'আগে একে গণধর্ষণের পদযাত্রা করা উচিত।' এটা নিছক কোনো 'রাগান্বিত মন্তব্য' নয়, এটা স্পষ্টত অপরাধ।

এটা নারীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রকাশ্য ঘোষণা। এটি নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাকে রূপান্তরিত করেছে নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়।

ঘটনার দুই দিন পর তীব্র বিক্ষোভের মুখে গতকাল অভিযুক্ত ওই শিক্ষার্থীকে মাত্র ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্যদিকে বরাবরের মতোই রাজনৈতিক সংগঠনগুলো দায় এড়িয়ে বলেছে, "সে আমাদের কেউ নয়।" অথচ হুমকির ভাষা, প্রেক্ষাপট এবং উদ্দেশ্য, সবই রাজনৈতিক।

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি ধারাবাহিক কৌশলের অংশ, যেখানে নারী নেতৃত্বকে পরিকল্পিতভাবে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচন ঘিরে নারী ও আদিবাসী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে চালানো হয়েছে সাইবারবুলিং, চরিত্রহনন এবং অপপ্রচার। বিকৃত ছবি, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, মিথ্যা তথ্য—সব ছড়ানো হয়েছে সংগঠিতভাবে। উদ্দেশ্য একটাই, তাদের মনোনয়ন ঠেকানো, প্রচারণা থামানো, নেতৃত্বের পথ বন্ধ করা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু নির্বাচনেও একই চিত্র। ছাত্রদলের নারী নেত্রীদের বিরুদ্ধে উঠেছে সাইবারবুলিং, 'ভিকটিম শেমিং' এবং সরাসরি শারীরিক হেনস্তার অভিযোগ। শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির সময় তাদের নিয়ে কটূ মন্তব্য, ধাক্কাধাক্কি, অপমান, সবই চালানো হয়েছে। প্রশাসন তখনও নিশ্চুপ থেকেছে।

নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের ছাত্রদলের সহসভাপতি মিলন খানকে আজ দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে ছাত্রদল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখনো কোনো সাড়া নেই।

তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়, তিনটি নির্বাচন। বার্তা একটাই: নারী নেতৃত্ব থামাতে ধর্ষণের হুমকি, ডিজিটাল অপমান এবং শারীরিক নিপীড়ন এখন রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়, যা একসময় জ্ঞানচর্চার জায়গা ছিল, আজ সহিংসতার প্রশিক্ষণশালায় রূপ নিচ্ছে।

ডিজিটাল পরিসর এই সহিংসতাকে আরও হিংস্র করেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, সবখানেই নারী প্রার্থীদের ভিডিও কেটে, বিকৃত করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তারা "অযোগ্য", "অশালীন" বা "অনৈতিক।"

তাদের পোশাক, ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। "এই পোশাকে কেউ নেতা হতে পারে?", "যে নিজেকে ঢাকতে জানে না, সে কীভাবে নেতৃত্ব দেবে?"—এসব প্রশ্ন নয়, এগুলো সাংগঠনিক সন্ত্রাস।

এসব চালানো হয় সংগঠিতভাবে। একাধিক ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে একযোগে ছড়ানো হয় একই ধরনের পোস্ট। ছাত্রসংগঠনের সদস্যরাও এতে যুক্ত থাকেন। পরে তারা দায় অস্বীকার করে দূরে দাঁড়ান।

উদ্দেশ্য একটাই: নারী প্রার্থীদের মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়া, তাদের প্রচারণা থামানো, নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। যাতে তাঁর প্রচারণা বন্ধ করেন, ক্যাম্পাসে যাওয়া এড়িয়ে চলেন, এমনকি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। বাস্তব নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত হয় ডিজিটাল আক্রমণ, যা মিলেমিশে তৈরি করছে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ।

বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠশালা নয়, এটি নৈতিক নেতৃত্ব তৈরিরও জায়গা। যদি এখানেই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বৈধতা পায়, তবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে ভয়, অপমান এবং নিপীড়নের ছায়ায়। ছাত্ররাজনীতি যদি নারীর জন্য নিরাপদ না হয়, তবে তা আর গণতান্ত্রিক থাকে না।

এই নীরবতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেকটি রাষ্ট্রীয় অসাম্য। দেশে একের পর এক আইন প্রণীত হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ। এসব আইন প্রয়োগ হয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, মতপ্রকাশ দমনে, ধর্মীয় মন্তব্য ঠেকাতে। অথচ নারীদের বিরুদ্ধে যখন অশ্লীলতা, হুমকি বা সহিংসতার ভাষা ব্যবহার করা হয়, তখন আইনের কার্যকারিতা যেন মিলিয়ে যায়।

অনলাইনে নারীর বিরুদ্ধে স্লাটশেমিং, বিকৃত ভিডিও, বাজে ক্যাপশন, চরিত্রহনন, সবই দণ্ডনীয় হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এসবের বিরুদ্ধে প্রশাসন নির্বিকার। ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল, টিকটক অ্যাকাউন্ট, সবখানেই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়ানো হচ্ছে। রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই এসব প্রতিরোধে?

আরও ভয়াবহ হলো, যখন কোনো নারী হেনস্তাকারী ধরা পড়ে, তখনও তাকে আইনের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয় না। বরং দেখা যায়, কীভাবে প্রভাবশালী মহল পুলিশ থেকে ছাড়িয়ে আনে, কীভাবে জামিন হয়, কীভাবে কারাগার থেকে বেরিয়ে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। মুন্সীগঞ্জের লঞ্চে নারীকে মারধরের ঘটনা, ঢাবিতে নারী শিক্ষার্থীকে উত্যক্ত করাই তার উদাহরণ।

দুই ঘটনাতেই অভিযুক্তকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়, রাজনৈতিক নেতারা তাকে সংবর্ধনা দেন। এই আচরণ নারীর প্রতি সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। বার্তা গেছে, নারীকে হেনস্তা করলে কিছু হয় না, বরং প্রশ্রয় মেলে।

আইন যদি সত্যিই কার্যকর হতে চায়, তবে সেটি কেবল মতপ্রকাশে নয়, নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষাতেও সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় এসব আইন কেবল ভয়ের হাতিয়ার হয়ে থাকবে, আর নারীর প্রতি সহিংসতা অব্যাহতভাবে বৈধতা পাবে।

আজ যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আগামীকাল আমরা আরও ভয়ংকর এক সংস্কৃতির সাক্ষী হব। তখন নারী নেতৃত্ব মানেই হবে ধর্ষণের হুমকি, অপমান আর অব্যাহত নিপীড়ন। আর প্রশাসনের নীরবতা সেই অপরাধকে আশ্রয় দেবে, প্রশ্রয় দেবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এভাবে নারীকে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দেয়, তবে তারা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে না—তারা পরিণত হবে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার দুর্গে।

নারীকে থামিয়ে দিলে শুধু নেতৃত্ব নয়, থেমে যায় গণতন্ত্রের যাত্রাও। তাই আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভয় ও অপমানের কারাগারে পরিণত হতে দেখব, নাকি এটিকে নিরাপদ জায়গা করে তুলব, যেখানে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদায় নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখতে পারে?

Comments

The Daily Star  | English

One killed in crude bomb blast during clash at Mohammadpur Geneva Camp

The victim, Zahid, was not involved in the clash and had gone out with friends when he got caught in the middle of the violence, family say

13m ago