আর কত শ্রমিক প্রাণ দিলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শেষ হবে?

ছবি: স্টার

অজানা ১৪, অজানা ১৫, অজানা ১২—এমন নানা সংখ্যা লেখা ছিল মর্গের ভেতরে ৭-৮ জন পোশাক শ্রমিকের পুড়ে কয়লা হওয়া দেহাবশেষ রাখা সাদা প্যাকেটে। বাকি মরদেহগুলো আরেক মর্গের ফ্রিজে।

প্রাপ্ত তথ্য মতো, তখনও মৃতের সংখ্যা ১৬—পুরুষ ৯, নারী ৭ জন। কয়লা দেহের মাঝেও কারো চোখ খোলা। প্যাকেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে 'অজানা ১৪'-এর উঁচিয়ে রাখা হাতটা। হয়তো বাঁচার বাসনায় শেষ চেষ্টা করছিল।

কেমন গুমোট, দমবন্ধ আর অসহায় বোধ হচ্ছিলো। দ্রুত বের হয়ে এলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহিম চৌধূরীসহ আরও কয়েকজন। জরুরি বিভাগ ও মর্গের সামনে তখনও কয়েকজন নিহতের স্বজন আপনজনকে শনাক্তের অপেক্ষায়।

দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আবারও দরজা খুলে দিলেন। ভাবছিলাম এই স্বজনরা কীভাবে তাদের খুঁজে পাবে, কীভাবে মেনে নেবে? কীভাবে তাদের জীবনে এই ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়াবে? তাদের একজনও যদি আমার পরিবারের কেউ হতো, কেমন লাগতো?

এসব ভাবতে ভাবতে রওনা দেই আহত শুকরুজ্জামান, সোহেল ও মামুনের সঙ্গে দেখা করতে—বার্ন ইউনিটে। সোহেল ছাড়া বাকী দুজনের সাক্ষাত পাই। তাদের কাছে ঘটনার খানিকটা জানতে পারি। খুব বেশি প্রশ্ন করাটা অন্যায় হবে মনে হলো। ওদেরও তখনও সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাড়া করছে, শরীরে ও মনে গভীর জখম!

১৪ অক্টোবর ২০২৫। ২৯ আশ্বিন ১৪৩২। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেট থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটারের কিছু দূরে মিরপুরের শিয়ালবাড়ি আবাসিক এলাকা। ওইদিন আর সবদিনের মতো সকালটা তখনও তেতে ওঠেনি। সবদিনের মতো কারখানার আশপাশ ঘিরে শ্রমিকদের পদধ্বনি। সকাল সকাল প্রাণচঞ্চল হয়ে কাজে যাচ্ছিলো ১৪ বছর বয়সী মাহিরা আক্তার, মাত্র ৭ দিন আগে বিয়ে করা এক দম্পতি, বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় থাকা তোফায়েল আহমদ (২১), নার্গিস আক্তার (১৮), নুরে আলম (২৩), সানোয়ার হোসেন (২২), আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৯), রবিউল ইসলাম রবিন (১৯), তোফায়েল আহমদ (২১), নার্গিস আক্তার (১৯), নজরুল ইসলামের (৪০), মুনাসহ বাকীরা। কে জানতো সেটাই জীবনের শেষ সুখ-দুঃখের দিন।

কারোরই জানা ছিল না, তাদের জীবন এক ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নেবে। এন আর ফ্যাশন ছিল বিইউবিটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে মিরপুর শিয়ালবাড়ির কিছুটা সামনে, একটু ভেতরের গলিতে। আলম ট্রেডার্স নামে গুদামের ঠিক উল্টো দিকে একটি পাঁচতলা ভবন—৩৫-৪০ জন শ্রমিকের কারখানা। তারা সবাই হুডি ও সোয়েটার বানায়। হুডি সম্ভবত দেশের বাজারে বিক্রি হতো। আর টেক্সোরা গ্লোবাল লি. নামে ব্রান্ডের পোশাক যেতো সৌদি আরবে। এমন তথ্য শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায়।

পরের দিন মর্গে যাওয়ার আগে ঘটনাস্থলে যাই আমরা কয়েকজন—সকাল ৭টার দিকে। সেখানেও এলাকাবাসী, অন্যান্য কারখানার শ্রমিক ও স্বজনদের অনেকে দাঁড়িয়ে। গুদামের রাসায়নিক দ্রব্যের এতো ভয়াবহতা যে, পাশের কারখানায় উদ্ধার কাজ করা গেলেও গুদামে তখন ঢুকতে পারেনি উদ্ধারকর্মীরা।

অনুমোদনহীন ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা রাসায়নিক ওই গুদামের ঠিক বিপরীতে ছিল বেশকিছু ছোট ছোট করাখানা। প্রতিদিনের মতো সেখানে শ্রমিকরা গিয়েছিল। সকাল ১১টা দিকে বিকট শব্দ হয়ে পাশের গুদামের লেলিহান আগুন আর ধোয়া তাদের শরীর স্পর্শ করে। ছাদের দরজা বন্ধ আর নীচের সরু দরজা দিয়ে সবাই আর প্রাণে বাঁচতে পারেনি। ১৪-১৫ বছরের শিশুরাও রেহাই পায়নি।

বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে গত ১৫ বছরের বেশি সময় শ্রমিকরা এই ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে বারবার। মালিকরা ক্ষমতার সঙ্গে প্রভাব খাটিয়ে বারবার পার পেয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও কি একই ঘটনা ঘটতে পারে? আমাদের আকাঙ্ক্ষা—শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য আমরা শ্রম কমিশন সংস্কার ও শ্রম আইন পরিবর্তনে শ্রমিকপক্ষের সুপারিশ দিয়েছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজের মধ্যে প্রাধান্য ছিল শ্রমখাত এবং এই খাতকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উপনীত করা। বারবার সেটা বলতে শুনেছি, আস্থাও করেছি।

কিন্তু মিরপুরের এই ঘটনা আমাদের মধ্যে আবারও প্রশ্ন-সংশয়-উদ্বেগ তৈরি করছে। মিরপুরের ১৬ শ্রমিকের ফরিয়াদ যেন আমাদের আবার ইতিহাসে ফিরে পাঠাচ্ছে। তাজরীন, হাশেম ফুড, চকবাজার, টিকাটুলি, রানাপ্লাজার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে।

ইতিহাস থেকে কখনো আমরা শিখি। আবার ইতিহাসের বড় শিক্ষা হচ্ছে, আমরা ইতিহাসের ভুল থেকেও শিখি না। তাই আশা রাখি, ইতিহাসের পাতা থেকে রসদ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অতিদ্রুত দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন মিরপুরের শ্রমিকদের প্রাণহানির বিচার করে। একইসঙ্গে শ্রমআইন ও শ্রমখাতের সংস্কারের পাশাপাশি এই ধরনের দুর্ঘটনা বা অবকাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের বিচার করে এই দেশে দৃষ্টান্ত রাখবে। আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীন গুদাম, রাসায়নিক গুদাম, বিপজ্জনক প্রতিষ্ঠান কীভাবে থাকতে পারে, তার জবাবও দেবেন।

পুড়ে মরা ১৬ প্রাণ—হয়তো সংখ্যা আরও বাড়বে। এই মিছিল লম্বা থেকে আরও লম্বা হচ্ছে। মিলিত হচ্ছে আরও আর্তনাদ। রানাপ্লাজা, তাজরীন, হাশেম ফুডসহ হাজারো প্রাণের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে স্বরগুলো যেন আবারো তাড়া করছে আমাদের। শ্রমিক সংগঠক, শ্রমিক, মালিক, সরকার—সবাইকেই তাড়া করছে। কেউই দায়মুক্ত নই আমরা।

সেই আর্তনাদ, ফরিয়াদ সরকারের কানে পৌছাবে সেই আশা করি। সরকারকে ভুললে হবে না। এই অজানা সংখ্যা নামে পরিচিত শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছে। প্রাণ দিয়েছে ছাত্র-জনতা। এতো প্রাণের বিনিময়েই ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। অনেক রক্তের দাগ লেগে আছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও রূপান্তরে।

বাংলাদেশের শ্রমখাত উন্নয়ন ও শ্রমিকের মর্যাদা একসুতায় গাঁথা। তাই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর করতে হলে শ্রমিকবান্ধন কর্ম পরিবেশ এবং শ্রমিকের মর্যাদা ও জাতীয় অর্থনীতির বিকাশকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।

আর কোনো প্রাণ ও স্বপ্ন হত্যা দেখতে চায় না বাংলাদেশ। নতুন বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে তৈরি হতে হবে। নির্বাচনের আগে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নতুন বাংলাদেশে নতুন বন্দোবস্ত শ্রমিককে বাদ দিয়ে কখনোই সম্ভব না। ১৬ শ্রমিকের মৃত্যুর শেষ মুহূর্তের চিত্কার বারবার যেন প্রতিধ্বনিত করছে—বিচার চাই, মানুষ হিসেবে মর্যাদা চাই, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই।


তাসলিমা আখতার: সভাপ্রধান, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন ও বাংলাদেশ গামে‍র্ন্ট শ্রমিক সংহতি

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh airport cargo fire losses

Airport fire may delay RMG, pharma production by at least two months

Local manufacturers are scrambling for raw materials after a massive fire destroyed imported production inputs at the cargo complex of Dhaka airport on Saturday.

10h ago