সরকার আসে সরকার যায়, বিশৃঙ্খল পরিবহন খাত শুধু হাত বদলায়

প্রতিদিন সকালে অফিসগামী মানুষের একটাই প্রার্থনা, 'আজ যেন কোনোভাবে সময়মতো পৌঁছাতে পারি।' ঢাকার রাস্তায় বের হলে মনে হয়, প্রতিটি মানুষ একেকজন যোদ্ধা—যাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে যানজট, ধোঁয়া, হর্ন, আর বেপরোয়া চালকদের প্রতিযোগিতার মধ্যে।
বাস থামবে কি না, থামলেও উঠতে পারব কি না, উঠতে পারলেও সিট পাব কি না—সবই নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর। আর ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণটা পুরোপুরি এমন এক সিস্টেমের হাতে, যার নাম 'বাংলাদেশের পরিবহন খাত'।
গোলাপি স্বপ্ন, ধুলোর বাস্তবতা
গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাস পর, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম ঘোষণা দিয়েছিলেন, আব্দুল্লাহপুর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা ২১টি কোম্পানির বাস একক কোম্পানির অধীনে আনা হবে। সব বাস হবে গোলাপি রঙের, টিকিট কাউন্টারভিত্তিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত।
এই ঘোষণার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, অবশেষে বিশৃঙ্খল এই খাতে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরবে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই গোলাপি রঙ হারিয়ে যায় ধুলোয়।
আমরা যেকোনো নতুন উদ্যোগেই আশার আলো দেখি। কিন্তু সেই আলো বারবার নিভে যায় দুর্নীতি, অসহযোগিতা আর স্বার্থের আঁধারে। প্রকল্পের শুরুতে আলো থাকলেও শেষ হয় অজুহাত।
স্টিয়ারিং কার হাতে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দেশের পরিবহন খাতের স্টিয়ারিং আসলে কার হাতে? দেখতে মনে হয় সরকারের হাতে, কিন্তু বাস্তবে সেটা নীতিহীন ক্ষমতার জোটের হাতে।
মালিক-শ্রমিক সমিতি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী, আর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট মিলে তৈরি করেছে এক অদৃশ্য রাজত্ব। সেখানে নিয়ম মানে ক্ষতি, বিশৃঙ্খলা মানে লাভ।
আর এই রাজত্বের ভার বহন করে চলেছে প্রতিদিনের যাত্রীরা।
চুক্তির জালে জিম্মি রাস্তাঘাট
বাসচালক আর বাসমালিকের সম্পর্ক ব্যবসায়িক নয়, বরং এক প্রকার বাজি। দিন শেষে মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয় চালককে—যেভাবেই হোক। ফলে চালকের আয় নির্ভর করে বেশি ট্রিপ আর বেশি যাত্রী তুলতে পারার ওপর।
এই 'চুক্তি সংস্কৃতি' পুরো গণপরিবহন খাতকে প্রতিযোগিতার নামে অবৈধতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। চালকরা হর্ন বাজিয়ে, স্টপেজ এড়িয়ে, রাস্তায় প্রতিযোগিতা করে নিজেদের আয় নিশ্চিত করছে। অথচ, যাত্রীদের চোখে এটা শুধু প্রতিযোগিতা না, তাদের বাঁচা-মরার খেলা।
কাগজে ফিট, রাস্তায় বিপর্যয়
প্রতিটি গাড়িরই নাকি ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে। কিন্তু রাস্তায় নামলেই বোঝা যায়—কাগজের সার্টিফিকেট আর বাস্তবের গাড়ি দুই জগতের জিনিস। অধিকাংশ বাস দেখতেই ভয় লাগে—সেগুলো এত ভাঙাচোরা। আবার দেখতে ঝকঝকে রঙ করা বাসের ভেতরে সিট ভাঙা, ব্রেক দুর্বল, আর ইঞ্জিন ক্লান্ত। কখনও ধোঁয়া ছুটে চোখে পানি আনে, কখনও ব্রেক ফেল হয়, কিংবা অন্য কোনো যান্ত্রিক গোলোযোগে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রশাসনের চোখের সামনে প্রতিদিন এসব অনিয়ম চললেও দায় নিতে কেউ রাজি নয়।
রাস্তায় বিশৃঙ্খলার পেছনে রাজনীতি
বাংলাদেশের পরিবহন খাত কেবল অবকাঠামো নয়, এটি রাজনীতিরও অংশ। কোন মালিক কাকে সমর্থন করে, কোন রুট কার দখলে—এই হিসাবেই চলে সিদ্ধান্ত।
একটি নতুন নীতি বা প্রকল্প মানে একদল ক্ষুব্ধ গোষ্ঠী, যারা ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধ শুরু করে দেয়। ফলে পরিকল্পনা হারিয়ে যায় মাঠের রাজনীতিতে, শৃঙ্খলা হারে স্বার্থের কাছে।
জবাবদিহির বাইরে তিন স্তর
পরিবহন খাতের দুরবস্থার জন্য দায়ী তিন স্তরের ব্যর্থতা—নীতি, তদারকি ও বাস্তবায়ন। নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বাস্তবতার বাইরে থেকে সিদ্ধান্ত নেন, তদারকি সংস্থাগুলো—যেমন: বিআরটিসি—কাগজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর বাস্তবায়নে থাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া।
ফলাফল, রাস্তায় ফিটনেসবিহীন বাস, লাইসেন্সবিহীন চালক, অনিয়ন্ত্রিত রুট আর অদৃশ্য চাঁদাবাজির অর্থনীতি।
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন স্বাধীনতা নাকি পুরনো চক্র?
গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ ভেবেছিল, এবার পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সড়কে তাকালে বোঝা যায়, শুধু শাসক বদলেছে, সিস্টেম নয়। একই বিশৃঙ্খলা, সিন্ডিকেট আর কণ্ঠস্বর—শুধু স্লোগান পাল্টেছে। আমরা যে 'দ্বিতীয় স্বাধীনতা'র কথা বলছি, সেই স্বাধীনতা এখনো পৌঁছায়নি রাস্তায়, চালকের সিটে বা যাত্রীর হাতে।
নতুন রং নয়, নতুন চিন্তা দরকার
বাংলাদেশের পরিবহন খাতের সমস্যার সমাধানে নতুন রং বা নতুন নাম নয়—নতুন চিন্তা প্রয়োজন। পেশাদার ব্যবস্থাপনা, ন্যায্য আয়ের কাঠামো ও কঠোর জবাবদিহি প্রয়োজন। যে দেশ মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠায়, সে দেশের রাজধানীর রাস্তায় সুশৃঙ্খল গণপরিবহন কি এত কঠিন? না, মোটেই কঠিন না—যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে।
শেষ কথা
ঢাকার রাস্তায় আজ প্রতিটি বাস একেকটি গল্প—ক্লান্ত চালক, রুষ্ট যাত্রী, অচল সিগন্যাল, নিস্তেজ সিস্টেম। এই গল্প বদলাতে হলে শুধু বাহন বা রং নয়, মানসিকতাও বদলাতে হবে।
গোলাপি বাসের মতো প্রতিটি উদ্যোগই আমাদের শেখায়—রং বদলালেই উন্নয়ন হয় না, বদলাতে হয় সিস্টেম।
যদি এখনই পরিবর্তনের পথে না হাঁটা যায়, তাহলে এই খাত কেবল হাত বদলাবে। পরিবহন শুধু চাকার গল্প নয়, দেশের চলার গল্প। আর এই গল্পে জনগণই হওয়া উচিত চালক—যাত্রী নয়।
জুবাইয়া ঝুমা, পিআর প্রফেশনাল
Comments