মানুষের তো আর ডিফেক্টস লায়াবিলিটি পিরিয়ড থাকে না

ছবি: স্টার

অক্টোবরের এক দুপুর। এই সময়টায় শহর সাধারণত ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেই ব্যস্ততার ধারায় উড়াল মেট্রোর নিচে চায়ের দোকানে আড্ডা জমে, ফুটপাতে মানুষের আনাগোনা বাড়ে, চলে ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, বাসের হেলপারের চোখ খুঁজে ফেরে যাত্রী। ঠিক এমনই এক ব্যস্ত দুপুরে আকাশ থেকে পড়ে মেট্রোর পিলারের বিয়ারিং প্যাড। আর প্রাণ যায় আবুল কালামের।

শরীয়তপুরের আবুল কালাম। বেচারার ভাগ্য হয়তো অন্য ১০ জনের মতো অতটা ভালো ছিল না। শৈশবে বাবা-মা হারানো কালাম চাকরি করতেন ট্রাভেল এজেন্সিতে। থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। সেই কাজেই এসেছিলেন ঢাকায়। তবে প্রাণ নিয়ে আর ফিরতে পারেননি।

ভর দুপুর, তাই তাই তখনো কোনো ছাপা পত্রিকায় এই খবর আসেনি। নিউজপোর্টালগুলোই ভরসা। আবুল কালামের এই মৃত্যুর খবর দেখে হয়তো অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই-চার কথা লিখেছি। কেউ হয়তো দুঃখ প্রকাশ করেছি, কেউবা ক্ষোভ ঝেড়েছি। কর্তৃপক্ষ ততক্ষণে মেট্রো চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। খবর পৌঁছে গেছে কালামের পরিবারে, চলছে স্ত্রীর আহাজারি।

তাদের ছোট্ট দুই সন্তান এই মেট্রোরেল বোঝে না, বোঝে না উন্নয়ন, বোঝে না মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড। তারা হয়তো মৃত্যুটাও বোঝে না। বাবার জন্য অসীম অপেক্ষার প্রহর গোনার তালিকায় নামটাও যে উঠে গেছে, সেটাও হয়তো জানে না। স্ত্রী হয়তো আহাজারির ফাঁকে ফাঁকে ভাগ্যটাকেও দুষতে শুরু করে দিয়েছেন।

ঘটনার দিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রী আইরিন স্বামীকে বিদায় দিতে চাননি, যাননি দরজাটা লাগাতেও। বিকেলে ফেরার কথা ছিল। ফেরাটা আর হলো না কালামের। ভাবিকে বলে রেখেছিলেন ইলিশ কিনে রাখতে, সেই ইলিশটা হয়তো জেলের জালেই ওঠেনি। দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনো এক মোহনায়।

এদিকে কিন্তু বরাবরের মতোই তদন্ত কমিটি গঠন হয়ে গেছে। না, ইলিশটা কেন জালে ওঠেনি, কমিটি সেই তদন্ত করবে না, মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত শেষ করে কমিটি প্রতিবেদন দেবে।

তদন্ত কমিটি সেবারও হয়েছিল। ২০২২ সালের আগস্টে ঢাকার উত্তরায় বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার পড়ে হতাহতের ঘটনায়। চলন্ত এক প্রাইভেটকারে সেবার গার্ডার পড়ে নিহত হন পাঁচজন। এমন দুর্ঘটনাগুলোতে কর্তৃপক্ষ সাধারণত দায় এড়ায় তদন্ত কমিটি গঠন করে।

প্রতিটি কমিটি হয়তো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরের মতো সামনে আসে না, হয়তো চাপা পড়ে থাকে লাল ফিতায় বাঁধা কোনো ফাইলে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ জানে না, দোষটা আসলে কার, শাস্তিটা কী হলো। শাস্তির নজির না থাকায় রাষ্ট্রীয় অবহেলা বাড়তেই থাকে।

গত বছরের দুটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক। ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্রেন থেকে কন্টেইনার পড়ে এক শ্রমিক নিহত হন। আগের দিনই একই প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলাকালে স্টিলের টুকরো পড়ে এক পথচারী নিহত হন। এসব ঘটনার দায় কার, সেসব খবরও অনেক ক্ষেত্রে সামনে আসে না। তাদের পরিবারের দিন কীভাবে কাটে, সেই হিসাবও কেউ রাখে না।

সেই দিক থেকে আবুল কালামের পরিবার ভাগ্যবান। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তার দাফনকাফনের সব ব্যবস্থা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ করবে। আর পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকার অর্থসহায়তা দেওয়া হবে। সঙ্গে পরিবারে যদি কর্মক্ষম কেউ থেকে থাকে, তাহলে যোগ্যতা অনুযায়ী পাবে চাকরি।

দেশে এখন মানুষের জীবনের দাম নোটে মাপা হয়। মৃত্যুরও রেট আছে, শুধু হালনাগাদ হয় সরকার পালাবদলে। সুপারশপে যেমন সাবানের সঙ্গে শ্যাম্পু ফ্রি পাওয়া যায়, তেমনি জীবনের বিনিময়ে নগদ টাকার সঙ্গে চাকরি ফ্রি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরেও ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়েছিল। সেবার অবশ্য কেউ মারা যাননি। সেই ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্রতিবেদনও দিয়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি?

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের এমডি ফারুক আহমেদ। 'আগের কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সবগুলো পিলার ফিজিক্যালি এক্সপার্ট দিয়ে পরিদর্শন করা হয়েছিল।'

এই উত্তরের বিপরীতে স্বাভাবিকভাবে সবারই মাথায় প্রশ্ন আসার কথা, ব্যবস্থা নেওয়ার পরও এমন ঘটনা আবার ঘটল কেন। পাশেই দাঁড়ানো উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও এমন প্রশ্ন তোলেন। তখন কি কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?

সবার প্রশ্ন মাথায় নিয়ে এমডির জবাব, তখন বলা হয়েছিল, ডিফেক্টস লায়াবিলিটি পিরিয়ডের মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছে। তাই ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন তারা নাকি জানিয়েছিল, সেটা সংশোধন করা হয়েছে।

অর্থাৎ ব্যবস্থার দৌড় এ পর্যন্তই। ডিফেক্টস লায়াবিলিটি পিরিয়ড বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে বোঝায়, যে সময়ে ঠিকাদার চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণকাজের ত্রুটিগুলো মেরামত করতে বাধ্য থাকে। সাধারণত এই সময়ের মধ্যে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে ঠিকাদারকে তা মেরামত করে দিতে হয়।

এবারকার তদন্ত কমিটির দায়িত্ব অবশ্য একটু বেশি। এই কমিটি আগের কমিটির প্রতিবেদনও দেখবে। উপদেষ্টা বলেন, 'এটা জাপানি ঠিকাদাররা করেছে। এখানে বলা হচ্ছে এটা ডিফেক্টস লায়াবিলিটি পিরিয়ডের মধ্যে ঘটেছে। তবে এখন যে কমিটি হচ্ছে, এই কমিটি আগের কমিটির রিপোর্টও দেখবে।'

কেন একাধিকবার ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ল, সেই ব্যাখ্যা হয়তো ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষের কাছে থাকতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে আসতে পারে সেই তথ্য। এরপরও তো প্রশ্ন থেকে যায়। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ কি নির্মাণ ত্রুটি, মানহীন উপকরণ, নাকি রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি?

একই ধরনের প্যাড তো মেট্রোরেলের অন্যান্য পিলারেও ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলো কি নিরাপদ? মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কি নিয়মিত পিলারসহ অন্যান্য অবকাঠামো, যন্ত্রাংশ দেখভাল করে, নাকি শুধু দুর্ঘটনা ঘটার পরই নড়েচড়ে বসে? ডিফেক্টস লায়াবিলিটি পিরিয়ডের মধ্যে কারো প্রাণ গেলে সেই দায়টা কার? 
 
দুর্ঘটনার পরের দিন দুপুর। মেট্রো কর্তৃপক্ষ ট্রেন চলাচল শুরু করে দিয়েছে। ততক্ষণে আবুল কালাম নামের এক তরুণের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। ফার্মগেট এলাকার ফুটপাতে রক্তের ছাপও মুছে যেতে শুরু করেছে। চায়ের দোকানগুলোও হয়তো বসতে শুরু করেছে। ফুটপাতে মানুষের আনাগোনাও শুরু হয়ে গেছে।  

তদন্ত কমিটি হয়তো প্রতিবেদন তৈরির কাজেও নেমে গেছে। আইনি কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। তখন কেউ কেউ হয়তো সড়কে দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে মেট্রোর দিকে তাকচ্ছেন। এ এক অনিশ্চিত দৃষ্টি। এই না আকাশ থেকে মৃত্যু এসে পড়ে, আবার তদন্ত কমিটি গঠন হয়! মানুষের তো আর ডিফেক্টস লায়াবিলিটি পিরিয়ড থাকে না। তাই মৃত্যুর পর জীবনটাও ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।

Comments

The Daily Star  | English

Farewell

Nation grieves as Khaleda Zia departs, leaving a legacy of unbreakable spirit

8h ago