‘দুই-তিন রাত ঘুমাতে পারিনি, সেই দুঃখ ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়’
রুবাইয়া হায়দার ঝিলিক তার ওয়ানডে অভিষেকেই খেলেন ম্যাচজয়ী অর্ধশতক, যার সুবাদে বাংলাদেশ ২০২৫ আইসিসি নারী বিশ্বকাপ অভিযানে জয় দিয়ে শুরু করেছিল। কিন্তু এরপর থেকেই ঝিলিকের ছন্দ ও বাংলাদেশ নারী দলের ভাগ্য দুটোই নিম্নমুখী হতে থাকে। ঝিলিক এখন আসন্ন টি২০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বকে সামনে রেখে ফুটওয়ার্ক উন্নত করতে বিশেষ ড্রিল অনুশীলন করছেন। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে গত বিশ্বকাপ অভিযান ও আসন্ন সূচি নিয়ে কথা বলেছেন।
বিশ্বকাপে ওয়ানডে অভিষেক করা কতটা বিশেষ ছিল আপনার জন্য?
রুবাইয়া হায়দার ঝিলিক: বিশ্বকাপের মতো একটা বড় মঞ্চে যাওয়াই ছিল দারুণ উত্তেজনার, আর সেখানে অভিষেক হবে—এই চিন্তায় তো আরও বেশি রোমাঞ্চিত ছিলাম। আত্মবিশ্বাসও ছিল কারণ বিশ্বকাপের আগে আমি বেশ ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার পরিবার কখনো কোনো প্রত্যাশা চাপিয়ে দেয়নি। তারা সবসময় বলত, 'তুমি যা করতে চাও করো, যা হবে ভালোই হবে।' এতে আমি খুব মুক্তভাবে খেলতে পেরেছি।
ক্রিকেটে আপনার যাত্রাটা একটু বলুন
ঝিলিক: ছোটবেলাতেই শুরু। যশোরের এক পত্রিকায় মেয়েদের ক্রিকেট অনুশীলনের একটা বিজ্ঞপ্তি বের হয়। আমার মামা প্রথম বলেন আমি যেন যাই। বাবা সবসময় চেয়েছিলেন তার প্রথম সন্তান ছেলে হলে ক্রিকেট শিখবে। আমি মেয়ে হয়ে জন্মালেও বাবা বললেন, 'ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখি।' তবে লেখাপড়ার চাপে খেলতে পারিনি তেমন, পরিবার পড়াশোনাকেই প্রাধান্য দিত। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার সময় খেলাই বন্ধ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে খুলনা বিভাগীয় দলে ঢুকি, তারপর এনসিএল, এরপর প্রিমিয়ার লিগে।
ডিভিশনাল দলে প্রথম দিকে ২-৩ বছর পানির বোতলই বয়ে বেড়িয়েছি (হাসি)। কিন্তু পরে মনে হলো, না, আমি যদি এটাকে পেশাগতভাবে নিই, তাহলে কিছু একটা করতে পারব। ছোটবেলা থেকেই স্কিল ভালো ছিল, তাই ক্রিকেটকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু করি।
বিশ্বকাপের পরিবেশ কেমন ছিল আপনার জন্য?
ঝিলিক: সম্পূর্ণ আলাদা অনুভূতি। মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের মধ্যে আছি। অনেক ভালো খেলোয়াড়কে কাছ থেকে দেখেছি, তাদের দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান—সবই শিখেছি। ওদের দেখে বুঝেছি, ওরা ক্রিকেটকে অন্যভাবে ভাবে, ওদের স্বপ্ন অনেক বড়। তখনই মনে হলো, নিজেকে বড় জায়গায় দেখতে চাইলে নিজের কাঁধেই প্রত্যাশার ভার নিতে হবে।
বিশ্বকাপে কাকে দেখে সবচেয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
ঝিলিক: স্মৃতি মান্ধানা। শেষ ম্যাচে তার ব্যাটিং দেখে খুব ভালো লেগেছিল, বিশেষ করে আমি যেহেতু বাঁহাতি, তাই তাকে আরও বেশি পছন্দ হয়েছে—খুব কুল ও শান্তভাবে ব্যাট করছিলেন। অ্যালিসা হিলিও অনুপ্রেরণাদায়ক, তিনি আমাদের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওদের দেখে মনে হয়েছিল, যেন অন্যদের মন পড়তে পারে—এইভাবেই তারা খেলে।
আপনি মনে করেন, তাদের বিশেষত্ব কোথায়?
ঝিলিক: অভিজ্ঞতায়। তারা বহু বছর ধরে খেলছে। ম্যাচের পরিস্থিতি আর অনুশীলনের পরিস্থিতি এক নয়। বেশি ম্যাচ খেলায় তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত।
তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছিল?
ঝিলিক: না, খুব কাছ থেকে কথা বলার সুযোগ পাইনি। কারণ ওদের কাছে যেতে পারার মতো স্বাধীনতা আমাদের ছিল না। তবে হ্যাঁ, কেউ সেঞ্চুরি বা ফিফটি করলে 'গুড ব্যাটিং' বলতাম, আর ওরাও আমাদের উৎসাহ দিত, বলত, 'তুমি ভালো করছ, পরের বার আরও ভালো হবে।'
জয়ের ক্ষুধা নিয়ে বাংলাদেশ দলকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে কী মনে হয়?
ঝিলিক: প্রত্যেক দলেরই জেতার ক্ষুধা থাকে। আমরা হয়তো সেটা ফলাফলে দেখাতে পারিনি। আমাদের প্রতিপক্ষ চাপের মুহূর্ত সামলাতে বেশি দক্ষ ছিল, আমরা ওখানেই পিছিয়ে গেছি। তবুও হারের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শিখেছি।
আপনি বাঁহাতি ব্যাটার, যা বাংলাদেশ নারী দলে বিরল। এটা কখনো সমস্যার কারণ হয়েছে?
ঝিলিক: ছোটবেলা থেকেই বাঁহাতি। বাঁ হাতে খাওয়া, লেখা—সবই করতাম, এজন্য অনেক বকাও খেয়েছি। সবাই বলত, 'ডান হাতে খাও কেন না?' কিন্তু যখন ব্যাট ধরলাম বাঁ হাতে, তখন কোচ খুব খুশি হলেন। তখনই বুঝলাম, বাঁহাতি হওয়াটা হয়তো একটা বাড়তি সুবিধা।
এখানে সফল হতে হলে কী প্রয়োজন বলে মনে করেন?
ঝিলিক: ফিটনেস বড় বিষয়। আরেকটা হলো ধারাবাহিকভাবে রান করা। বড় দলগুলোর খেলোয়াড়রা নিয়মিত রান করে—প্রতিদিন ফিফটি বা সেঞ্চুরি নয়, কিন্তু প্রতি ম্যাচে ২৫-৩০ করেই। আমারও আত্মবিশ্বাস ছিল, অভিষেকে ভালো করার পর নিয়মিত রান করতে পারব। কিন্তু সেটা হয়নি। তবু বিশ্বকাপ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
আপনার অনুশীলনে এখন রিফ্লেক্স এক্সারসাইজ আছে—এর পেছনের ভাবনা কী?
ঝিলিক: ফুটওয়ার্ক আর ক্রিজ ব্যবহার—এ দুটো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বড় দলের খেলোয়াড়রা উইকেটে এগিয়ে খেলে, ক্রিজ ব্যবহার করে নানা শট খেলে। দ্রুত পায়ের ব্যবহার, শরীরের রিঅ্যাকশন—সবই দরকারি। এসব নিয়ে কাজ করলে ব্যাটিংয়ে উন্নতি হবে বলে বিশ্বাস করি। এখন ফুটওয়ার্ক ও রিঅ্যাকশন নিয়ে কাজ করছি। সাজিব ভাইয়ের (ব্যাটিং কোচ নাসিরউদ্দিন ফারুক সাজিব) ড্রিলগুলো মূলত ব্যাটিং স্কিল, ফুটওয়ার্ক ও শরীরের ভারসাম্য বলের দিকে নেওয়ার কৌশল নিয়েই।
বিশ্বকাপে দলীয় ব্যবস্থাপনা থেকে কতটা সহায়তা পেয়েছেন?
ঝিলিক: অনেক সাহায্য পাই। সবচেয়ে বড় বিষয়, ওরা আমাদের মানসিকভাবে মুক্ত রাখে। ইমার্জিং দলের সফরে সজিব ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার পর আমার ব্যাটিংয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তিনি আমাদের খুব ভালোভাবে বোঝেন। ম্যানেজমেন্টও সবসময় পাশে থাকে—কখন কী প্রয়োজন, কীভাবে আরও ভালো করা যায়, সব সময়েই পরামর্শ দেয়। মন খারাপ থাকলে অনুপ্রেরণা দেয়।
আপনার প্রিয় শট মনে হয় লফটেড ড্রাইভ?
ঝিলিক: হ্যাঁ, এই শটটা আমার কাছে সহজাতভাবে আসে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্র্যাকটিস ম্যাচে আমার ৩৩ রানের মধ্যে বেশিরভাগই লফটেড শট ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষেও সেটাই পছন্দের শট। তবে বিশ্বকাপে একই শট খেলতে গিয়ে কয়েকবার আউটও হয়েছি। সময়ের অভাবে তখন বিশেষ কাজ করা যায়নি, কিন্তু সজিব ভাই বলেছিলেন শটটা কিছুটা সংযত করতে। এখন সেটাতেই কাজ করছি। কিছু টেকনিক ঠিক করলে এটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করি।
এখন কী ধরনের ড্রিল করছেন?
ঝিলিক: ফুটওয়ার্ক নিয়ে। পায়ের নড়াচড়া আর ব্যাট সুইং ঠিক রাখতে কাজ করছি। এনসিএল (টি২০) সামনে, ওখানে এগুলো কাজে লাগাতে পারি কি না, সেটাই দেখছি।
বিশ্বকাপের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি আপনার জন্য?
ঝিলিক: পাকিস্তান ম্যাচটাই আমার জীবনের বড় অর্জন। কারণ, অভিষেক ম্যাচে জ্যোতি আপু (নিগার সুলতানা) আমাকে ক্যাপ দেন। বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের জন্য অনেক ভালো কিছু নিয়ে আসো।' ম্যাচের আগে বলেছিলাম, 'আজ যদি জিতি, এটা আমার জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।' জয় পাওয়ার পর সবাই খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। মনে হয়েছিল, 'হয়তো এবার বিশ্বকাপে আমরা বড় কিছু করতে পারব।'
ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ের খুব কাছে গিয়েও হেরেছেন, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় হাতছাড়া—তখন কী অনুভব হয়েছিল?
ঝিলিক: খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হিদার নাইটের ক্যাচ ফেলেছিলাম, ওটা ধরতে পারলে হয়তো জিততাম। দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারের পর ২-৩ রাত ঘুমাতে পারিনি। সেই দুঃখ ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।
পরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল কেন হারলেন?
ঝিলিক: তখন আমরা নিজেদের প্রমাণ করতে পারিনি। ম্যানেজমেন্ট কখনো চাপ দেয়নি, বরং বলেছে, 'তোমরা পারবে, শুধু ম্যাচ জিতে সেটা প্রমাণ করতে হবে।' ম্যাচ জিততে হলে ছোট ছোট ভুল ঠিক করতে হবে, বড় ভুলের জায়গা নেই। ওই ছোট ভুলগুলোই শেষ মুহূর্তে ম্যাচ হাতছাড়া করায়। ওরা বলেছে, 'যা গেছে তা নিয়ে ভাবো না, সামনে যা আছে তাতে মন দাও।'
একটি মাত্র ম্যাচ জিতলেও দলীয় মূল্যায়ন কেমন ছিল?
ঝিলিক: ভালো দিক হলো, এবার আমরা বিশ্বকাপে মোট আটটি ফিফটি করেছি। যদিও সেঞ্চুরি হয়নি, কিন্তু এটা ইতিবাচক দিক। সোবহানা, সুপ্তা আপু দুজনের দুটি করে ফিফটি, জ্যোতি আপুর একটি, স্বর্ণার একটি—এভাবে। ২০২২ সালে একটা মাত্র ফিফটি হয়েছিল, এবার আটটা। এটা উন্নতির ইঙ্গিত। তবে ঘাটতিগুলোও আমরা চিহ্নিত করেছি। এগুলো ঠিক করতে পারলে আরও ভালো করা সম্ভব।
নারী এনসিএল টি২০ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
ঝিলিক: টি২০ ফরম্যাটে ভাবার সময় নেই। দ্রুত রান তুলতে হয়। তাই এনসিএলকে সামনে রেখে দ্রুত রান করার চেষ্টা করছি, স্ট্রাইক রোটেশনেও মন দিচ্ছি।
টি২০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব সামনে—ওটা নিয়ে পরিকল্পনা কী?
ঝিলিক: এই কারণেই আমাদের এনসিএল আয়োজন করা হয়েছে। কারণ বাছাইপর্ব আসছে। ওয়ানডে আর টি২০ আলাদা ফরম্যাট, টি২০-তে শক্তি ও গতি দরকার। তাই এখন টি২০ ফরম্যাটে বেশি মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে। এই টুর্নামেন্ট থেকে আমরা অনেক কিছু শিখব।
টি২০ ব্যাটিংয়ের জন্য আলাদা পরিকল্পনা আছে?
ঝিলিক:হ্যাঁ, টি২০ ব্যাটিং মানেই বড় শটে ফোকাস করতে হবে। স্ট্রাইক রোটেশনও জরুরি। ফুটওয়ার্কের ব্যবহারও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন এগুলো নিয়েই ভাবছি।


Comments