বিসিবি পরিচালকদের অনাস্থা প্রস্তাবের কৌতূহলোদ্দীপক দিক

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফারুক আহমেদ, তার ওপর বোর্ডের ভেতর থেকে সংস্কারের গুরুদায়িত্ব ছিল। কিন্তু সংস্কার উদ্যোগ শুরু হওয়ার আগেই নয় মাসের মাথায় তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলো। তার বিদায় নিয়ে অনেক ফিসফাস ও তত্ত্ব প্রচলিত আছে, কিন্তু কী কারণে তার অকাল প্রস্থান হলো তা একটি অমীমাংসিত প্রশ্নই রয়ে গেছে। সরকারি ব্যাখ্যা এই রহস্যকে বরং আরও ঘনীভূত করেছে, কোনো স্পষ্টতা দেয়নি।
সভাপতিত্বের নয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর বোর্ডের দৈনন্দিন কাজকর্ম সামলানো ফারুকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল; তিনি যে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূরণ করা তো দূরের কথা। মাঠের ভেতরে ও বাইরে উভয় পরিস্থিতিই ছিল হতাশাজনক। জাতীয় দল ধুঁকছিল, ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ঘুরছিল এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ছিল ব্যাপক—অথচ এসব অব্যবস্থাপনা ফারুক ঠিক করার অঙ্গীকার করেছিলেন।
এগুলোই কি তার পতনের কারণ? অনুমান এবং নাটক একপাশে রেখে, আনুষ্ঠানিক বিবৃতির দিকে নজর দেওয়া যাক।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) ফারুকের পরিচালক পদ বাতিলের দুটি কারণ উল্লেখ করেছে: ১. আটজন বর্তমান বিসিবি পরিচালকের দাখিল করা অনাস্থা প্রস্তাব। ২. বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বিসিবির মসৃণ কার্যক্রম বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা।
সুতরাং, দুটি বিষয়: অনাস্থা প্রস্তাব এবং বিপিএল বিতর্ক।
অনাস্থা প্রস্তাবে ফারুকের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব, বারবার সংবিধান লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়। উপরন্তু, পরিচালকরা দাবি করেন যে তার আচরণ প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, দলের পারফরম্যান্সের অবনতি ঘটিয়েছে এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের গুরুতর সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।
মন্ত্রনালয়ে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষরকারী আটজন পরিচালক হলেন: নাজমুল আবেদীন ফাহিম, ফাহিম সিনহা, সাইফুল আলম স্বপন চৌধুরী, ইফতেখার রহমান মিঠু, মাহবুব আনাম, কাজী এনাম আহমেদ, মনজুর আলম এবং মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
মজার কথা হলো নাজমুল আবেদীন ফাহিম ছাড়া (যিনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফারুকের সঙ্গে বোর্ডে যোগ দিয়েছিলেন) বাকি সবাই দীর্ঘদিনের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের অধীনে পূর্ববর্তী বিসিবি প্রশাসনের অংশ ছিলেন। এই ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কি পাপনের প্রশাসনের বিরুদ্ধে এমনভাবে কথা বলেছিলেন যেভাবে তারা এখন ফারুকের বিরুদ্ধে বলেছেন?
উদাহরণস্বরূপ, মাহবুব আনামের কথা ধরা যাক—যাকে প্রায়শই "সব সময়ের জন্য একজন মানুষ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়—তিনি প্রায় প্রতিটি সরকারের অধীনেই বিসিবি প্রশাসনে একজন নিয়মিত ব্যক্তি। তিনি কি কখনো প্রকাশ্যে কোনো পূর্ববর্তী প্রশাসনের অন্যায়ের বিরোধিতা করেছেন?
কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেবেন যে ফারুক নয় মাসে পাপনের এক দশকেরও বেশি সময়ের চেয়ে বেশি কিছু অর্জন করেছেন—অথবা থিতু অবস্থা আরও বাজেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছেন।
এটিও উল্লেখযোগ্য যে ফারুকের বোর্ডের মধ্যেই, বিসিবি টেন্ডার ও ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুব এবং বিসিবি অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান সিনহা উভয়ই ব্যাংকিং লেনদেনের অনুমোদনকারী স্বাক্ষরদাতা ছিলেন। এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে: কেন শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে কথিত অন্যায়ের জন্য এককভাবে দায়ী করা হবে, বিশেষ করে যখন অন্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল?
শাসনব্যবস্থা—বিশেষ করে বিসিবির মতো একটি জটিল সংগঠনে—একটি সম্মিলিত দায়িত্ব। যদি ভুল পদক্ষেপ ঘটে থাকে, তবে যারা মূল কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন বা সমর্থন করেছিলেন তাদেরও অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
একই ব্যবস্থার অংশীদার অন্যদের অব্যাহতি দিয়ে কেবল ফারুককে এককভাবে দায়ী করা 'সিলেক্টিভ জাস্টিসের' ইঙ্গিত দেয়—এবং সম্ভবত পারফরম্যান্সের একটি মূল্যায়নের চেয়ে এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল।
বিসিবির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বোর্ড পরিচালকরা তাদের সভাপতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন। এবং লক্ষণীয়ভাবে, যারা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা পূর্ববর্তী প্রশাসনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন।
ফারুকের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও অনৈতিক চর্চার অভিযোগ আনা হয়, যা পূর্ববর্তী প্রশাসনের সময় থেকেই এই সিস্টেমে বিদ্যমান ছিল, যার বেশিরভাগ বর্তমান পরিচালকই অংশ ছিলেন। যদি ফারুককে এর জন্য দায়ী করা হয়, তবে তাদের কেন নয়?
আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বর্তমান কর্তৃপক্ষ পূর্ববর্তী বোর্ডের পরিচালকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের নিজস্ব মনোনীত সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তারপর রয়েছে বিপিএল ইস্যু। যদি টুর্নামেন্টকে ঘিরে বিতর্ক এতটাই গুরুতর হয় যে একজন সভাপতিকে পদত্যাগ করতে হয়, তবে কেন শুধুমাত্র ফারুককেই জবাবদিহি করা হলো? কেন বিপিএলের সদস্য সচিব নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে জড়ানো হলো না? বরং, নতুন বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের অধীনে ফাহিমকে সহ-সভাপতি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই বিষয়ে জড়িত দুজন ব্যক্তির সঙ্গে কেন এত ভিন্ন আচরণ করা হলো?
যে প্রশ্নটি এখনও বড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা হলো ফারুক উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যায্য বিচার পেয়েছিলেন কিনা। কারণ, অভিযোগের গুরুতরতা সত্ত্বেও, তার বরখাস্তের আগে কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা বা সুস্পষ্ট প্রমাণ কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
Comments