‘প্রতিটি ফেডারেশনে ৩০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত’
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম সম্প্রতি টিম ম্যানেজমেন্ট ও সাপোর্ট স্টাফের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও অসদাচরণের অভিযোগ তুলেছেন, যা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাটি আবারও খেলাধুলায় নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
এই প্রেক্ষাপটে নারী ক্রীড়াবিদদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় কণ্ঠস্বর, সাবেক চ্যাম্পিয়ন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার ডানা দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন।
সাবেক ক্রীড়াবিদ ও বর্তমান সংগঠক হিসেবে আপনি জাহানারা আলমের অভিযোগগুলো কীভাবে দেখছেন?
কামরুন নাহার ডানা: এটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না, কীভাবে নিন্দা জানাই। আমি নিশ্চিত অভিযুক্তরা এই অভিযোগ অস্বীকার করবে, কারণ তারা মনে করে মেয়েরা দুর্বল—কিন্তু আমরা তা নই।
অন্যান্য খেলাতেও এর আগে এমন অভিযোগ উঠেছে, বারবার এমন ঘটনা ঘটছে কেন?
ডানা: আমি মনে করি এটি ঘটছে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে। সেই ফেডারেশনগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের মানসিকতাও সম্ভবত অপরাধীদের মতোই। তা না হলে তারা কেন ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তি দেয় না? এমন অভিযোগের প্রতি তাদের উদাসীনতাই অপরাধীদের আবারও একই কাজ করতে উৎসাহিত করে, কারণ তাদের শাস্তি পাওয়ার কোনো ভয় নেই।
এমন পরিস্থিতিতে একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে পারফর্ম করা কতটা কঠিন?
ডানা: একজন খেলোয়াড়ের জন্য এমন ঘৃণ্য প্রস্তাব পাওয়ার পর পারফর্ম করা সত্যিই খুব কঠিন। সে কি খেলবে নাকি নিজেকে রক্ষা করবে? এই অবস্থায় একজন নারী খেলোয়াড় ভয়াবহ মানসিক চাপে থাকে, কারণ বিষয়টি প্রকাশ করলে তা কেলেঙ্কারিতে রূপ নিতে পারে এই ভয়ে সে চুপ থাকে। জাহানারা সাহস করে বিষয়টি প্রকাশ করেছে, কিন্তু সবাই তা পারে না। ক্রিকেটে হয়তো ৩০ জন জাহানারা আছে যারা এখনো মুখ খোলেনি।
আপনি কি মনে করেন, এমন ঘটনা মেয়েদের খেলাধুলায় আসার আগ্রহ কমিয়ে দেয়?
ডানা: অবশ্যই। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের খেলাধুলায় পাঠানোর আগে দ্বিধায় ভুগবেন। আপনি কি দেখেছেন কোনো নামী সংগঠক নিজের ছেলে বা মেয়েকে খেলাধুলায় পাঠাচ্ছেন? না, কারণ তারা জানেন এই পথে ভবিষ্যৎ নেই, পরিবেশ নেই, নিরাপত্তা নেই। আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত সেই পরিবারগুলোর প্রতি, যারা তাদের সন্তানদের—বিশেষ করে মেয়েদের—খেলাধুলায় অংশ নিতে দেন। যদি আমরা এই মেয়েদের সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে নারী ক্রীড়াবিদ পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
কেউ কেউ বলছে, জাহানারা দল থেকে বাদ পড়ার পর অভিযোগ তুলেছে—এটা নাকি তার মানহানির উদ্দেশ্যে। আপনি কি এই যুক্তিকে সঠিক মনে করেন?
ডানা: সে হয়তো তখন ভয় পেয়েছিল—দল থেকে বাদ পড়বে এই আশঙ্কায় বিষয়টি প্রকাশ করেনি। কিন্তু স্পষ্টতই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, যা তার পারফরম্যান্সেও প্রভাব ফেলেছিল। আমি মনে করি, একজন নারী খেলোয়াড় এমন সমস্যা প্রথমে নিজেই সমাধানের চেষ্টা করে, পরে না পারলে প্রকাশ করে। তাই এমন অভিযোগ উঠলে, এর পেছনে সবসময় কিছু না কিছু ভিত্তি থাকে।
আপনি কি মনে করেন, পুরুষ-প্রধান কোচিং স্টাফ ও টিম ম্যানেজমেন্টই এমন ঘটনার মূল কারণগুলোর একটি?
ডানা: হ্যাঁ, এটি অন্যতম প্রধান কারণ। যদি কোচিং প্যানেল ও টিম ম্যানেজমেন্টে নারী সদস্য থাকত, তাহলে এমন ঘটনার কোনো সুযোগ থাকত না। আমি জানতে চাই, কেন ফেডারেশনগুলো প্রাক্তন নারী খেলোয়াড়দের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগ দেয় না? কেন বিদেশ সফরে নারী দলের সঙ্গে নারী কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় না?
দেশের নারী ক্রীড়াকে এই সমস্যামুক্ত করা সম্ভব কীভাবে?
ডানা: অলিম্পিক চার্টারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি জাতীয় ফেডারেশনে ৩০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। কিন্তু আমরা তা মেনে চলছি না। এটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা জরুরি, যাতে জাতীয় ক্রীড়া সংগঠনগুলোতে নারী সংগঠকের সংখ্যা বাড়ে। নারী কোচ ও কর্মকর্তাদের যুক্ত করতে হবে, যাতে তারা নারী বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। ফেডারেশনগুলোকে প্রাক্তন নারী ক্রীড়াবিদদের কোচ, আম্পায়ার ও কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে নারী দলের জন্য পুরোপুরি নারী স্টাফ তৈরি হয়।
একসময় আমরা সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বিরেন শিকদারকে রাজি করাতে পেরেছিলাম, যাতে তিনি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি সার্কুলার জারি করেন—যাতে বলা হয় শুধুমাত্র নারী ম্যানেজার ও কর্মকর্তা নারী দলের সঙ্গে ভ্রমণ করতে পারবেন। কিন্তু তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেই সার্কুলার কার্যকর থাকেনি। এখন আমাদের আবারও এর জন্য লড়তে হবে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এমন অভিযোগ উঠলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আজীবনের জন্য খেলাধুলা থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

Comments