বাফুফের পেট্রোনাস বিভ্রম: যা রূপ নিল বৈশ্বিক প্রহসনে
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) দীর্ঘকাল ধরে ভুল করতে পারদর্শীতা দেখিয়ে আসছে। সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের টানা চারবারের মেয়াদে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি প্রায়শই অপেশাদার আচরণ করত। পাশাপাশি নেতৃত্বের সুস্পষ্ট অভাবের কারণে তারা নিজেদেরকে জাতীয় পর্যায়ে হাসির খোরাকে পরিণত করেছিল।
শিল্পপতি থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বাফুফের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে তাই প্রত্যাশা অনেক। এক বছরের সামান্য বেশি সময় আগে শপথ নেওয়া এই কমিটির শুরুর দিকের লক্ষণগুলো ছিল আশাব্যঞ্জক: প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে জায়গা পেয়ে নারী জাতীয় দল অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে এবং পুরুষ জাতীয় দলে বেশ কয়েকজন হাই-প্রোফাইল প্রবাসী খেলোয়াড়ের আগমন ঘটায় দেশের ফুটবলে আগ্রহ ও উদ্দীপনার নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়।
তবুও যেন মনে হচ্ছে, দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী ক্রীড়া সংস্থাটি নিজেদেরকে হাসির খোরাকে পরিণত করার পুরানো অভ্যাস ছাড়তে পারছে না! মালয়েশিয়ার বহুজাতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোনাসকে জড়িয়ে সম্প্রতি যে বিপর্যয়টি ঘটল, তা এখন বাফুফেকে আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রত করেছে।
আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নামে পরিচিত বাংলাদেশ ফুটবল লিগ (বিএফএল) দুই মাস ধরে কোনো টাইটেল স্পনসর ছাড়াই চালানোর পর গত রোববার ২০২৫-২৬ মৌসুমের লোগো উন্মোচন করে বাফুফে। সেখানে পেট্রোনাসের লোগোও ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি দাবি করা হয়, এই ব্র্যান্ডটি দেশের পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের টাইটেল স্পন্সর।
স্পন্সরশিপের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাফুফের সহ-সভাপতি ও মার্কেটিং কমিটির চেয়ারম্যান ফাহাদ করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'আমরা দুই মাসেরও বেশি সময় আগে (পেট্রোনাসের অনুমোদিত স্থানীয় পরিবেশক ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে) চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপ তাদের বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে কোনটি দিয়ে লিগের নামকরণ করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় নেওয়ায় ঘোষণা দিতে দেরি হয়েছে।'
এমন অনাড়ম্বর ও সাদামাটা ঘোষণা শুরুতেই সন্দেহ তৈরি করেছিল। কিন্তু আসল ধাক্কাটা আসে পরের দিন সকালে, যখন পেট্রোনাস একটি বিবৃতি দিয়ে স্পন্সরশিপ চুক্তির দাবি প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি বিএফএলের সঙ্গে তাদের যে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা পরিস্কারভাবে অস্বীকার করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'সম্প্রতি বাংলাদেশ ফুটবল লিগের কথিত টাইটেল স্পন্সরশিপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলো সম্পর্কে অবগত হয়েছে পেট্রোনাস। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, বাংলাদেশ ফুটবল লিগের সঙ্গে কোনো স্পন্সরশিপ চুক্তি করেনি পেট্রোনাস এবং এই লিগের সঙ্গে আমাদের নাম বা ব্র্যান্ড ব্যবহারের কোনো অনুমতিও আমরা দিইনি।'
এই খবর দ্রুত পূর্ব এশিয়ার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা বিএফএল ও এর পেছনে থাকা বাফুফের বিদ্যমান ভঙ্গুর বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছে।
বিপদের ইঙ্গিত অবশ্য আরও আগেই পাওয়া গিয়েছিল। গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএফএলের একটি খসড়া লোগো ফাঁস হয়। এর সঙ্গে দুটি বর্তমান লোগোর অবিশ্বাস্য মিল পাওয়া যায়: একটি স্বাস্থ্য ও ফিটনেস বিষয়ক অ্যাপের লোগো এবং আরেকটি অস্ট্রেলিয়ার পেশাদার ফুটবল লিগের সর্বোচ্চ স্তরের লোগো। ফাঁস হওয়া সেই লোগো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিমের ঝড় তোলে। সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ নকশা নির্বাচন করায় বাফুফেকে তীব্র উপহাস করেন নেটিজেনরা।
দেশের ফুটবল ফেডারেশনের সন্দেহজনক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তাদের কাছে এই ঘটনায় অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিছু ভালো চুক্তি করলেও, নতুন মার্কেটিং কমিটি বারবারই নাম-পরিচয়হীন বা অপরিচিত কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এসব চুক্তি থেকে আসলে কারা লাভবান হচ্ছে?
এর চেয়েও খারাপ ব্যাপার হলো, পেট্রোনাসকে জড়িয়ে এই বিপর্যয় (যা আইনি ঝামেলাও তৈরি করতে পারত) খোলাখুলিভাবে সামলানোর বদলে বাফুফে যেন ধামাচাপা দিতে চাইছে। বারবার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ার পর, বাফুফে শেষমেশ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়েছে, ইউনাইটেড গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হেলথ কেয়ারকে বিএফএলের টাইটেল স্পন্সর হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাফুফে আরও দাবি করেছে, 'পেট্রোনাস ঘোষণা করেছে, তারা এই মৌসুমের জন্য টাইটেল স্পন্সর হিসেবে অংশ নিতে পারবে না।' অথচ তাদের এই দাবি পেট্রোনাসের সকল সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে দেওয়া বিবৃতির সঙ্গে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইউনাইটেড গ্রুপের পিআর ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান আরিফ হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ইউনাইটেড হেলথ কেয়ারই দেশের সর্বোচ্চ ফুটবল আসর বিএফএলের টাইটেল স্পন্সর হবে এবং পুরো ঘটনাটি একটি 'ভুল বোঝাবুঝি'র ফল।
কিন্তু কোন পক্ষ এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য দায়ী এবং একটি নিম্নমানের ঘরোয়া লিগের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য একটি বহুজাতিক কর্পোরেশনের নাম তড়িঘড়ি করে জুড়ে দেওয়ার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে— এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো অর্থবহ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।


Comments