ফিরে দেখা ২০২৫

ফুটবলে আশা, উন্মাদনা ও হতাশার বছর

Hamza Choudhury & Sheikh Morsalin
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ঢাকায় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি খুঁজে পাওয়া ছিল অনেকটা গুপ্তধন খোঁজার মতো। দোকানের শো-কেসগুলোতে তখন ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর জার্সির দাপট ছিল, আর বাকি জায়গা দখল করে রাখত ক্রিকেটের জার্সি। বাংলাদেশ ফুটবল দলের জার্সি যদি পাওয়াও যেত, তবে তা পড়ে থাকত দোকানের কোনো এক অবহেলিত কোণে।

২০২৫ সালের শেষে এসে দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। সবুজ ছোপ আর লাল নকশা সংবলিত সেই চিরচেনা সাদা জার্সি এখন স্পোর্টস শপ থেকে শুরু করে ফুটপাতের স্টল—সবখানেই সগর্বে ঝুলছে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো সংখ্যায় ক্রিকেট বা ইউরোপীয় ক্লাবের জার্সিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

বহু বছর পর ফুটবলের প্রতি মানুষের এই উন্মাদনা বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছে এবং কিছু সময়ের জন্য ক্রিকেটকে তার দীর্ঘদিনের সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। পুরুষ দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে গ্যালারি ভর্তি দর্শক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরন্তর চর্চা এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বাড়তি মনোযোগ—সবই ফুটবল পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যার জন্য সমর্থকরাও ছিলো দীর্ঘকাল অপেক্ষায়।

এই পুনর্জাগরণের পেছনের কারণটি ছিল স্পষ্ট। লেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরীর জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তি দেশের ফুটবল অঙ্গনে এক বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা তৈরি করে। এরপর একে একে যোগ দেন ক্যাভালরি এফসি-র শমিত সোম, প্রতিভাবান তরুণ ফাহমেদুল ইসলাম, জায়ান হাকিম ও কিউবা মিচেলের মতো প্রবাসী খেলোয়াড়রা। তাদের আগমনে দেশের ফুটবলে জন্ম নেয় এক নতুন বিশ্বাস—বিশ্বাস যে বাংলাদেশ ফুটবল অবশেষে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

আশার পারদ আকাশচুম্বী হলো। জাতীয় দলটি আগের চেয়ে অনেক বেশি বাজারজাতযোগ্য হয়ে উঠল, স্পন্সরদের আগ্রহ বাড়ল, জার্সি ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রির ধুম পড়ল এবং জাতীয় স্টেডিয়াম আবারও ফুটবলীয় উন্মাদনায় মুখরিত হলো। কিন্তু বছরটি যত এগিয়েছে, একটি পরিচিত এবং হতাশাজনক বাস্তবতা আবারও সামনে চলে এসেছে: মাঠের পারফরম্যান্স মাঠের বাইরের সেই উন্মাদনার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

অনেকের মতেই, ১৯৮০ সালের পর প্রথমবারের মতো এএফসি এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলার একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের সামনে। ২৪ দলের টুর্নামেন্টে গ্রুপ 'সি'-তে ভারত, হংকং এবং সিঙ্গাপুরের সাথে জায়গা পেয়ে হ্যাভিয়ের কাবরেরা ও তার দলের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে বাছাইপর্ব পার হওয়া সম্ভব।

শিলংয়ে ভারতের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র দিয়ে অভিযানটি আশাব্যঞ্জকভাবেই শুরু হয়েছিল—যে ম্যাচটি বাংলাদেশের অনায়াসেই জেতা উচিত ছিল। তবুও, এটি ছিল একটি দাপুটে পারফরম্যান্স, যা বাকি বাছাইপর্বের জন্য সুর বেঁধে দিতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এটি শেষ পর্যন্ত একটি 'ভ্রান্তি' হিসেবেই প্রমাণিত হলো।

সেই ড্র থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার বদলে কাবরেরার শিষ্যরা ঘরের মাঠে খেই হারিয়ে ফেলল। সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের কাছে টানা দুটি হারে বাছাইপর্বের স্বপ্ন কার্যত শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

স্কোরবোর্ড দেখে লড়াইটি হাড্ডাহাড্ডি মনে হলেও বাস্তবতা ছিল রূঢ়। সংস্কারকৃত জাতীয় স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক চিৎকার করে সমর্থন দিলেও মাঠের লড়াইয়ে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল।

ফলাফল খারাপ হতে থাকলে শুরু হয় কড়া সমালোচনা। কোচের কৌশলগত পছন্দ, দল নির্বাচন এবং খেলোয়াড়দের অপরিচিত পজিশনে খেলানো নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়। তবে এসব সমালোচনা জবাবদিহিতার জায়গায় খুব একটা পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্প্যানিশ কোচের ওপর আস্থা রাখা অব্যাহত রাখে, যিনি বছর শেষে জাতীয় দলের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধান কোচ হিসেবে নিজের নাম লেখান।

সাফল্যের এই হাহাকার বছরের শেষ পর্যন্তও ছিলো, যতক্ষণ না একটি স্মরণীয় জয় সব গ্লানি মুছে দেওয়ার সুযোগ করে দিল। ২০২৫ সালের শেষ দিকে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানের জয়টি ছিল ঐতিহাসিক। এই জয়ের মাধ্যমে প্রতিবেশীদের বিপক্ষে দীর্ঘ ২২ বছরের জয়হীন যাত্রার অবসান ঘটে এবং লক্ষ লক্ষ সমর্থক এক পরম আনন্দঘন রাত উপহার পায়। এটি ছিল আবেগ আর প্রতীকের মিশেলে এক বিশাল জয়, যা দীর্ঘকাল স্মরণে থাকবে।

কিন্তু সেই জয়ও একটি বৃহত্তর সত্যকে পুরোপুরি আড়াল করতে পারেনি।

মানসম্পন্ন খেলোয়াড়ের আগমন, নজিরবিহীন জনসমর্থন এবং নতুন করে জেগে ওঠা বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল কাজের সময় প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বছরটি সেই পরিচিত চক্রেই আটকে ছিল—প্রথমে আশা, তারপর বুক ভাঙা বেদনা; সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি থাকলেও মাঠের ভুল আর সুযোগ নষ্টে সব ভেস্তে যাওয়া। ভারতের বিপক্ষে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত জয়টি এসেছে ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে মূল লক্ষ্য থেকে ছিটকে গেছে বাংলাদেশ।

________________________________________

২০২৫ সালে বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দলের পরিসংখ্যান:

•     মোট ম্যাচ: ৮ (প্রতিযোগিতামূলক: ৫, প্রীতি ম্যাচ: ৩)

•     জয়: ২, ড্র: ৪, হার: ২

•     গোল করেছে: ১০, গোল খেয়েছে: ৯

•     ফিফা র‍্যাঙ্কিং: ১৮৫ থেকে ১৮০-তে উন্নীত (বছর শেষে)

Comments