বিশ্বজুড়ে নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে দাপটের বছর
২০২৫ সাল বিশ্বজুড়ে নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য স্মরণীয় বছর। এবছর নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা, দর্শক সংখ্যায় হয়েছে রেকর্ড। ভারতের মেয়েরা প্রথমবার জেতে বিশ্বকাপ। ইউরোপিয়ান ফুটবলে নারীদের খেলায় বেড়েছে রেকর্ড দর্শক। যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের বাস্কেটবল লিগ ডব্লিউএনবিএ হয়েছে সম্প্রসারিত। বাংলাদেশের নারীদের সাফল্যও উল্লেখ করার মত। ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা ইতিহাস গড়ে ২০২৬ এএফসি নারী এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ক্রিকেটে সীমিত প্রস্তুতিতে প্রত্যাশাপূরণ না হলেও চেষ্টা ছিলো চোখে পড়ার মত।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা নিজেদের এক ঐতিহাসিক বছর পার করেছেন। কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় এবং কোচের মধ্যে মনোমালিন্য থাকা সত্ত্বেও দলটি প্রথমবারের মতো ২০২৬ এএফসি নারী এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আয়োজক মিয়ানমার, বাহরাইন এবং তুর্কমেনিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ তাদের বাছাইপর্বের গ্রুপে শীর্ষস্থান দখল করে। এর মধ্যে বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ৭-০ গোলের দাপুটে জয় এবং উচ্চতর র্যাঙ্কিংয়ের মিয়ানমারের বিপক্ষে স্মরণীয় ২-১ গোলের জয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের ফলে ফিফা নারী বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ১২৮তম থেকে ১০৪তম স্থানে উঠে আসে। আগস্টের শুরুতে তারা ছিল র্যাঙ্কিংয়ের সবচেয়ে বড় লাফ দেওয়া দল, যা দেশের মাটিতে নারী ফুটবলের এক যুগান্তকারী বছরকে তুলে ধরে।
ক্রিকেটে নিগার সুলতানা জ্যোতির নেতৃত্বাধীন টাইগ্রেসরা ওয়ানডে বিশ্বকাপে একটির বেশি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় যৌথভাবে আয়োজিত বিশ্বকাপে আশা দেখিয়েছিল। বাংলাদেশ তাদের অভিযান শুরু করেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশাল জয় দিয়ে। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জেতার পরিস্থিতি তৈরি করেও জিততে পারেনি।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল বিশেষভাবে যন্ত্রণাদায়ক। ২০৩ রান তাড়া করতে গিয়ে বাংলাদেশ মাত্র ৭ রানে হেরে যায়; শেষ পাঁচটি উইকেট তারা হারিয়েছিল মাত্র এক রানের ব্যবধানে ৬টি বলের মধ্যে। এই আকস্মিক ধস একটি ঐতিহাসিক জয়কে একটি বেদনাদায়ক পরাজয়ে পরিণত করে। তা সত্ত্বেও, টাইগ্রেসরা উচ্চতর র্যাঙ্কিংয়ের দলগুলোর বিপক্ষে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কোনো আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি ম্যাচের আয়োজন করতে না পারায় তাদের বয়সভিত্তিক ছেলেদের দলের বিপক্ষে খেলে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল।
বিশ্বমঞ্চে ভারতের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মুহূর্ত
বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্রিকেট বছরের অন্যতম সেরা মুহূর্ত উপহার দিয়েছে যখন ভারত, তাদের প্রথম নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করে। এই বিজয় ভারতজুড়ে উদযাপনের জোয়ার বইয়ে দেয়। মুম্বাইয়ের রাস্তাগুলো উৎসবে রূপ নেয়; আতশবাজিতে আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে এবং জনতা গভীর রাত পর্যন্ত নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।
দেশজুড়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ড্রয়িং রুম পর্যন্ত ভক্তরা টেলিভিশনের পর্দার সামনে ভিড় করেছিলেন, যা একটি সাংস্কৃতিক মাইলফলক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এই জয় ভারতের শীর্ষ নারী ক্রিকেটারদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বা বাজারমূল্য আকাশচুম্বী করে তুলেছে, যা প্রমাণ করে মাঠের সাফল্য কীভাবে ব্যাপক স্বীকৃতি এবং পরিচিতিতে রূপ নেয়।
ইউরোপজুড়ে ফুটবল ভাঙছে বাধা
২০২৫ সালে নারী ফুটবলের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা অব্যাহত ছিল, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। ফাইনাল ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই টুর্নামেন্টের টিকিট বিক্রির পরিমাণ ২০২২ সালের আসরকে ছাড়িয়ে যায়, যা নারী ফুটবলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও আগ্রহেরই বহিঃপ্রকাশ।
আয়োজক সুইজারল্যান্ড প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে সবার নজর কেড়ে নেয়। মূলত স্কিইং এবং টেনিস খেলোয়াড় তৈরির জন্য পরিচিত দেশটিতে এই সাফল্য নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। স্পেনের কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার পর কোচ পিয়া সুন্ধাগে এই মুহূর্তের বৃহত্তর প্রভাব নিয়ে বলেন, 'আমরা ম্যাচটি হেরেছি, কিন্তু আমার মনে হয় আমরা অনেক কিছু অর্জন করেছি। যখন মানুষ আমার নাম ধরে চিৎকার করছিল, আমার মনে হচ্ছিল তারা আসলে নারী ফুটবলের জন্যই চিৎকার করছিল।'
মাঠের বাইরে আর্সেনাল লিভারপুল থেকে কানাডিয়ান ফরোয়ার্ড অলিভিয়া স্মিথকে ১০ লক্ষ পাউন্ডে দলে নিয়ে নারী ফুটবলের দলবদলের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। তিনি হলেন সাত অঙ্কের (মিলিয়ন পাউন্ড) ঘরোয়ানা স্পর্শ করা প্রথম নারী ফুটবলার।
নতুন উচ্চতায় দর্শক সংখ্যা
২০২৫ সালে দর্শকদের উপস্থিতির রেকর্ড নাটকীয়ভাবে ভেঙে গেছে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে আয়োজিত নারী রাগবি বিশ্বকাপে। ৪ লক্ষ ৪০ হাজারেরও বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছিল—যা ২০২১ আসরের তুলনায় তিন গুণ। টুইকেনহ্যামে অনুষ্ঠিত ফাইনালটি ৮১,৮৮৫ জন দর্শক মাঠে বসে দেখেছিলেন, যা নারী রাগবি ম্যাচের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
মোট দর্শকদের অর্ধেকেরও বেশি ছিলেন নারী, যাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রথমবারের মতো নারী রাগবি ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাজ্যে এই টুর্নামেন্টের টেলিভিশন দর্শক সংখ্যা ৫.৮ মিলিয়নে পৌঁছেছিল।
ডব্লিউএনবিএ এবং নতুন লিগগুলোর অগ্রযাত্রা
ডব্লিউএনবিএ আরও সম্প্রসারণ এবং প্রভাবের ইঙ্গিত দিয়ে বছর শেষ করেছে। লিগটি ১৩টি দলে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ১৫টি ও ২০৩০ সালের মধ্যে ১৮টি দলে পৌঁছানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
আ'জা উইলসন একটি দাপুটে মৌসুম পার করেছেন। তিনি প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চারবার ডব্লিউএনবিএ এমভিপি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং একই সঙ্গে তৃতীয়বার বছরের সেরা রক্ষণাত্মক খেলোয়াড় ও ফাইনাল এমভিপি নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে লাস ভেগাস এসেস গত চার মৌসুমের মধ্যে তাদের তৃতীয় শিরোপা জিতেছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তার উপস্থিতি এবং নাইকির প্রচারণা তার প্রভাবকে আরও জোরালো করেছে।
ডব্লিউএনবিএ-র বাইরে ২০২৫ সালে বেশ কিছু নতুন লিগ যাত্রা শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে আনরাইভালড থ্রি-অন-থ্রি নারী বাস্কেটবল লিগ, নারী পেশাদার বেসবল লিগ, লিগ ওয়ান ভলিবল এবং কানাডার নর্দার্ন সুপার লিগ। সম্মিলিতভাবে এই লিগগুলো এমন একটি বছরকে প্রতিফলিত করে যেখানে নারী ক্রীড়াঙ্গন কেবল নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়নি, বরং এর পরিধি, দৃশ্যমানতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও বহুগুণ প্রসারিত করেছে।


Comments