উচ্চশিক্ষায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কোথায়

উচ্চশিক্ষা, গবেষণাপত্র,
ছবি: সংগৃহীত

আমার শিক্ষার্থীরা যারা সদ্য পাস করে বহির্বিশ্বে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের প্রায়ই বলতে শুনি, তেমন কোনো পাবলিকেশন বা গবেষণা প্রবন্ধ নেই। এটা একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় উচ্চশিক্ষায় আবেদনের ক্ষেত্রে। আমি নিজেও যখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়েছি, দেখলাম সেখানকার শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা যেই মানের গবেষণা কাজ করছেন, সেই সমমানের কাজ আমার নিজেরও তেমন নেই।

শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের এবং শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে গবেষণাধর্মী পাঠদান বা কারিকুলাম সেভাবে নেই। বিশেষ করে আমরা যারা সামাজিক বিজ্ঞানের নানান বিষয়ে পড়ছি। গবেষণা, মনোগ্রাফ এমনকি থিসিস, যতটুকুই শেখানো হয় সেটার পরিসরও কম থাকায় একটা সেমিস্টারে প্রকৃত অর্থেই গবেষণা কীভাবে করতে হয় এবং গবেষণার যেই ফল বা ফাইন্ডিংস, সেটাকে কীভাবে নতুন কাজে এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয়, সেগুলোর হাতেখড়ি হয় না আমাদের কোর্সগুলোতে।

যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপে শুধুমাত্র 'আর ওয়ান' কিংবা রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে, যেখানে একজন অধ্যাপকের অন্যতম দায়িত্বই হলো কাজের নির্দিষ্ট একটি শতাংশ গবেষণাকাজে ব্যয় করা এবং এই কাজটি ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য ফান্ডের ব্যবস্থা করা। আর ওয়ান ছাড়াও শুধু টিচিং বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজ রয়েছে যেখানে শিক্ষককে তেমন গবেষণায় সময় ব্যয় করতে হয় না। শিক্ষক সেখানে তার কাজের অধিকাংশ সময়টাই ক্লাস নেওয়ার কাজে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যয় করবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা নিজেদের দক্ষতা ও পছন্দ অনুযায়ী তাদের পেশা বেছে নেন।

আসলে গবেষণাকাজ শুধু তাদের জন্যই যারা প্রকৃত অর্থেই দীর্ঘ একটা সময় এবং তাদের শ্রম এই কাজে ব্যয় করতে আগ্রহী। এবং এসব শিক্ষক, অধ্যাপকের জন্য তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, একেকটি ফ্যাকাল্টি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। একজন শিক্ষক যাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে ভালো একটি গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করতে পারে, সেজন্য আনুষঙ্গিক কাজের চাপ বা কোনো প্রশাসনিক কাজের ভার শিক্ষককে নিতে দেখিনি। শ্রেণিকক্ষের বাইরে যেই সময়টুকু গবেষণা কিংবা নিজের ব্যক্তিগত পড়াশোনার জন্য একজন শিক্ষক ব্যয় করেন, সে সময়টুকুও তার দাপ্তরিক কর্মঘণ্টা হিসেবেই ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দেখেছি এর উল্টো চিত্র। এমনকি শিক্ষকদের এমন কোর্স পড়াতে দেওয়া হয়, যা হয়তো বিগত কারিকুলামে ছিল না, পর্যাপ্ত গবেষণার সময় দেওয়া হয় না। এতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

আরেকটি বিষয় যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি যা গবেষকের জন্য বেশ উৎসাহের। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কনফারেন্স, সিম্পোজিয়ামগুলোতে যাওয়ার জন্য ফান্ড থেকে শুরু করে, কীভাবে ভালোমানের একটি কাজ তৈরি করতে হবে, কীভাবে তা উপস্থাপন করতে হবে, এসবের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করা। শুধু অভিজ্ঞ অধ্যাপকেরাই নন, প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদেরও দেখেছি পার্টিসিপেন্ট, ভলান্টিয়ার হিসেবেও এসব কনফারেন্সে অংশ নিতে। যা নবীন গবেষকের তার কাজের প্রতি আগ্রহ, আগামীতে তার কর্মক্ষেত্রসহ নানা বিষয়ের সুযোগ করে দেয়। কনফারেন্স, সিম্পোজিয়ামগুলোকে তাই নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য খুব প্রয়োজনীয় মনে করা হয় সেখানে।

একেকটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ভালোমানের গবেষণা কাজ বা প্রস্তাবনা নির্বাচিত হওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নানা রিভিউ, বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, বহুজনের কাজের মধ্য থেকে বাছাই শেষে একেকটি গবেষণাকাজ নির্বাচিত হয় কনফারেন্সে উপস্থাপনের জন্য। এবং এই প্রত্যেকটি কনফারেন্সেই নির্দিষ্ট কিছু খরচ থাকে। এখন অনলাইনে উপস্থাপনের সুযোগ থাকলেও রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে প্রত্যেককে আবেদন করতে হয়। কিন্তু এই ফি কিংবা আনুষঙ্গিক যেই ফান্ডিং, সেটার খুব কম ব্যবস্থাপনার সুযোগ রয়েছে আমাদের এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। এতে আসলে একজন গবেষকের যে দক্ষতা, তার কাজের যে মূল্যায়ন তা হয়ে ওঠে না।

একইভাবে আমাদের এখানে শ্রেণিকক্ষে যেভাবে পড়ানো হয়, সেই বিষয়গুলোও গবেষণাকেন্দ্রিক না। যুক্তরাষ্ট্রে যে বিভাগে পড়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানে বছর বা সেমিস্টার শেষে লিখিত ফাইনাল পরীক্ষা নেই। বরঞ্চ প্রতিদিনই একজন শিক্ষার্থীকে প্রচুর গবেষণা আর্টিকেল পড়ে কিছু বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন, আলোচনা প্রফেসরকে মেইল করে দিতে হয়। এর ওপরই পুরো সেমিস্টারে একজন শিক্ষার্থীর গ্রেডিং নির্ধারিত হয়। এবং সেমিস্টারের শুরুতেই কোর্স শিক্ষক ঠিক করে দেন, কোন শিক্ষার্থী কী বিষয়ে গবেষণা প্রস্তাবনা তৈরি করবে, সিলেবাসের কোন বিষয়ে শিক্ষার্থী নিজে একদিন ক্লাস নিবে এবং সেই ক্লাসে তার বাকি সহপাঠীদের কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এমনকি একজন শিক্ষার্থীর প্রশ্ন কতটা বিশ্লেষণধর্মী, তার ওপরও সেমিস্টারে ফল নির্ধারিত হয়। এবং সেমিস্টার শেষে সেই শিক্ষার্থীর গবেষণা কাজ সবথেকে ভালো হয়, সেই শিক্ষার্থীকে অধ্যাপক নিজেই বিষয়ভিত্তিক কনফারেন্স বা সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন।

তাই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু লেকচারভিত্তিক নয়, বরং শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপন করতে দেওয়া, কোর্স অনুযায়ী গবেষণা প্রস্তাবনা, গবেষণা কাজ ভালো হলে শিক্ষকের সঙ্গে কোনো কনফারেন্সে উপস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রেফারেন্স, তথ্য-উপাত্তসহ ক্লাসের পাঠদান অনেক বেশি আলোচনাধর্মী হওয়া দরকার। এতে একটি ক্লাসের বিভিন্ন শিক্ষার্থীর নানান মত, যুক্তিতর্ক যেমন উঠে আসে তেমনি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ধারণাও পরিষ্কার হয়। আর সব থেকে মূল বিষয় হলো, প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যে অংশ নিচ্ছে, নিজেদের মতামত প্রকাশ করছে। এতে গঠনমূলক প্রশ্ন করার যে দক্ষতা সেটাও গড়ে ওঠে।

Comments

The Daily Star  | English
Largest Islamic bank in the making

Largest Islamic bank in the making

The five banks slated for consolidation are First Security Islami Bank, Union Bank, Global Islami Bank, Social Islami Bank and Exim Bank.

12h ago